অনুবাদ: ড. আবু উসামা মুহাররম
পরবর্তি অংশ…
৭- হাদিস অধ্যয়ন
আহলে বাইত (আঃ) এর জ্ঞান- বিজ্ঞানকে পুনরুজ্জীবিত করার পথে, আল্লামা তাঁর শিক্ষক ফায়েজের পথ অনুসরণ করেন। প্রথম ধাপে তিনি কুতুবে আরবাআ তথা “গ্রন্থচতুষ্টয়” অধ্যয়ন ও পর্যালোচনা করেন। এরপর”কাফি ও তাহযিবের ব্যাখ্যা লেখার সময়, তিনি তার একছাত্রকেমান লা ইয়াহযুরুহুল ফকিহ-এর একটি ব্যাখ্যা লিখতে উৎসাহিত করেন। যেটির উপর তার পিতা একটি ব্যাখ্যা লিখেছিলেন।(১৮) তিনি দীর্ঘদিন যাবত হাদিস থেকে বিচ্ছিন্ন ছাত্রদেরকে হাদিস অধ্যয়ন ও গবেষণা করতে উৎসাহিত করেন এবং যুগের অনিষ্ট থেকে কুতুবে আরবাআ গ্রন্থগুলোকে সংরক্ষণ ও রক্ষা করতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করতে এগিয়ে আসেন। তিনি ঘোষণা করেন “কোন ছাত্র যদি কুতুবে আরবা’ লেখে, তবে তারা তার কাছ থেকে সনদের অনুমতি পাবে। ছাত্ররা উৎসাহের সাথে আরবাহ বই লিখতে শুরু করে এবং কপিগুলো আল্লামার কাছে নিয়ে যায় এবং তিনি তাদের অনুলিপির পিছনে নিজের হাতের লেখা দিয়ে তাদের অনুমতি লিখে দেন। (১৯)
আল্লামা মনে মনে ভাবলেন যে, কুতুবে আরবা’র পড়ানো এবং আরও কিছু কিতাব যেমন ‘আরশাদে মুফিদ’, কাওয়াদে আল্লামা’ এবং ‘সহীফাহ সাজ্জাদিয়ে’ এসব কিতাবকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা প্রয়োজন।, তবে অন্যান্য বইয়ের ক্ষেত্রে কী করা উচিত? শিয়া মাযহাবের হাজার হাজার বই যা লুটেরা ও বকধার্মিকদের চুল্লিতে ছাই হয়ে গিয়েছিল। সেই সাথে সেই সময়ের ঘটনা থেকে নিরাপদ বা লুকিয়ে থাকা বা পৃথিবীর দূরবর্তী স্থানে সরিয়ে নেওয়া ঐতিহ্যের শত শত ছোট-বড় সংস্করণের কথা চিন্তা করে বুকের কোণে এক তীব্র ব্যাথা অনুভূত হতো। অন্যদিকে, শিয়ামতের মূল্যবান ভাণ্ডার ধ্বংসে অন্যান্য মাযহাবের ধর্মান্ধতা সীমা অতিক্রম করেছিল। আর পূর্ব ও পশ্চিমের দুই বৃহৎ শক্তি আহলে সুন্নাতদের হাতে সাফাভি (শিয়া) রাষ্ট্রের পতনের সম্ভাবনা প্রবল হয়ে ওঠে। আবার রাজদরবার ও সমাজের সূফীদের হাতে অনেক হাদিস বিকৃত করার পরিকল্পনা, হাদিসের বইয়ের প্রতি ছাত্রদের অমনোযোগিতা প্রকট হয়ে ওঠে। এভাবে আহলে বাইতের জ্ঞানের সম্পদসমূহ ধ্বংসের ঝুঁকিতে ফেলা হয়।
তাই তিনি শিয়া মাযহাবের সংকলনগুলো এমনভাবে উদ্ধারের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা শুরু করেন। এই অব্যাহত প্রচেষ্টায় তিনি শিয়া মাযহাবের চারশটি মূল নথির মধ্যে দুইশত মূলনথি উদ্ধার করতে সক্ষম হন। তিনি সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সংকলনগুলো সংগ্রহ করেন। এমনকি যখন আল্লামাকে জানানো হয়ে যে ইয়েমেনের একটি গ্রন্থাগারে “মদিনাতুল আলম” বইটির একটি অনুলিপি পাওয়া গেছে, তখন আল্লামা শাহের সাথে এই তথ্যটি শেয়ার করেন। শাহ ইয়েমেনের রাজার কাছে অনেক মূল্যবান উপহার সহ দূত পাঠান এবং তার কাছে “মদিনা আল-আলম” বইটি চেয়ে বসেন, কিন্তু অজানা কারণে সেই বইটি কখনই আল্লামাহের কাছে পৌঁছায়নি। (২০)
আল্লামা তার বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক কাজের ধারাবাহিকতায় অতীতের অনেক বই পুনরুদ্ধার করেন যেগুলো আলেমগণ বিভিন্ন বিষয়ে লিখেছেন এবং ছাত্রদেরকে সেগুলো অনুলিপি করার জন্য উৎসাহিত করেছেন। যে বইগুলো ধুলোয় মলিন হয়ে গিয়েছিল, কেউ সেগুলো সম্পর্কে জানত না বা ততদিনেও কেউ অধ্যয়ন করেনি। তার নিজ হাতে উক্ত গ্রন্থটির নীচে লিখেন যে, এই বইটি হারিয়ে গিয়েছিল আজ অবধি কেউ এটি পড়েনি। (২১)
৮ – লেখক
আল্লামা তার সময়ের মানুষের সাংস্কৃতিক চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেছেন। এক সময়, তিনি অনুভব করেছিলেন যে মানুষের জ্যোতির্বিদ্যা দরকার, তাই তিনি এখতিয়ার বইটি লিখেন। যেহেতু তিনি অনুভব করেছিলেন যে সমাজকে আল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, তাই তিনি “আইনুল হায়াত এর মতো নৈতিকতায় সিক্ত বইটি লিখেন।
তাঁর ফারসি কাজগুলি ছিল মানুষের ধর্ম ও জগতের কল্যাণের জন্য এবং মানুষের পথনির্দেশের জন্য । খুব কমই শিয়াদের বাড়ি ছিল যেখানে তার একটি বই পাওয়া যায় নি এবং তা থেকে কেউ উপকৃত হয়নি। তার বইগুলো থেকে আরব ও পারস্য, অজ্ঞ ও অতীন্দ্রিয়, পুরুষ, নারী এমনকি শিশুরাও উপকৃত হতো।
৮.১ – আরবি রচনা
আল্লামা মাজলেসির আরবি ভাষায় বেশ কিছু রচনা রয়েছে।
৮.১.১ – বিহারুল আনওয়ার
আল্লামা বিহারুল আনওয়ারের ভূমিকায় লিখেছেন: “আমার কাজের শুরুতে, আমি বিখ্যাত এবং সাধারণ বইগুলি অধ্যয়ন করেছি, এবং তারপরে আমি অন্যান্য বইগুলির দিকে ফিরেছি যেগুলি বিগত যুগে বিভিন্ন কারণে পরিত্যক্ত ছিল। যেখানেই হাদিসের সংস্করণ ছিল, সেখানেই গিয়েছি। আমি এটি থেকে যে কোনও মূল্যে উপকৃত হয়েছি। অনেক বইয়ের কপি সংগ্রহ করার জন্য আমি পূর্ব ও পশ্চিমে অনুসন্ধান করেছি। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একদল ধার্মিক ভাই আমাকে সাহায্য করেন । আল্লাহর রহমতে প্রয়োজনীয় উত্সগুলি পেতে শহর, নগর এবং দূরবর্তী অঞ্চলে গিয়েছি। বইগুলি সংশোধন ও পরিমার্জন করার পরে, আমি তাদের বিষয়বস্তু সম্পর্কে সচেতন হয়েছি। আমি যে বইগুলিকে অনুপযুক্ত বলে মনে করেছি বা বিভিন্ন অধ্যায়ে হাদিসের শ্রেণীবিভাগ খুঁজে পাইনি যা গবেষকদের জন্য সহায়ক হবে। তাই আমি একটি তালিকা তৈরি করার চেষ্টা করেছি যা প্রতিটি উপায়ে আকর্ষণীয় এবং দরকারী হবে। ১০৭০ হিজরিতে, আমি অন্যান্য বইয়ের তালিকা করা বন্ধ করে দিয়েছিলাম কারণ আমি জনসাধারণের আগ্রহ দেখিনি । আমি সমাজের নেতাদের দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অপ্রীতিকর হিসাবে দেখেছি। আমি ভয় পেয়েছিলাম যে আমার পরে, আমার নকল কপিগুলি পরিত্যক্ত হবে বা কোন বিপর্যয়ের মধ্যে পতিত হবে। লুটেরাদের অত্যাচারের কারণে, কপি প্রস্তুত করার জন্য আমার প্রচেষ্টা বৃথা যায়। তাই আমি আমার পথ পরিবর্তন করি, আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করি এবং বিহারুল আনওয়ার লিখতে শুরু করি…” (২২)
“… আমি চিন্তা করছি যে যদি মৃত্যু অবকাশ দেয় এবং আল্লাহর রহমত আমাদের সাহায্য করে। তাহলে আমরা অন্যান্য পণ্ডিতদের উদ্দেশ্যে “বিহারুল আনওয়ার” এর ব্যাখ্যায় একটি সম্পূর্ণ বিবরণ লিখব ।
ইমাম খোমেনি বিহারুল আনোয়ার সম্পর্কে বলেন:
“বিহার হল ইসলামের পূরবসুরিদের দ্বারা আরোপিত সমস্ত খবরের ভান্ডার, তা সত্য হোক বা মিথ্যা। এতে এমন বিষয় রয়েছে যা বিহারের মালিক নিজে ঠিক বলে মনে করেন না। তিনি কোন বৈজ্ঞানিক বই লিখতে চাননি। , যাতে কেউ অভিযোগ না করে যে আপনি কেন এই বিষয়গুলো অবতারণা করেছেন। (২৪)
৮.১.১.১ – বিহারুল আনওয়ার বই সম্পর্কে ইমাম খোমেনির মতামত
ইমাম খোমেনি মুহাম্মাদ বাকের মাজলিসির বিহারুল আনওয়ার বইটিকে চারশত বই এবং অনেক ছোট পুস্তিকার সংগ্রহ বলে মনে করেন; বরং একধাপ এগিয়ে এটাকে তিনি বিহার আল-আনওয়ারের নামে একটি ছোট গ্রন্থাগার বলে মনে করেন। তিনি উল্লেখ করেন যে মাজলেসী সেই সমস্ত বই ও প্রবন্ধ সংগ্রহ করেন, যেগুলি ছোট আকারের পুস্তিকা এবং দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার কারণে এগুলো ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। সেগুলির বাছবিচারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ না হয়ে তিনি সংকলন করেন। অথবা ইসলামের আদেশ ও আইনগুলো পরীক্ষা করে সঠিকগুলো খুঁজে বের করার জন্য তিনি খুব একটা সতর্কতা অবলম্বন করেন নি। বিহারুল আনওয়ারের সমস্ত তথ্য যুক্তির অজুহাতে প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব নয়। এটি নির্দিষ্ট মানদণ্ডে পরিমাপ করা উচিত এবং এর সঠিকতা এবং ভুলতা নির্ধারণ করা উচিত।
ইমাম খোমেনি তার রচনায় আল্লামা মাজলেসির কিছু নীতির পর্যালোচনা ও সমালোচনা করেছেন। আহলে হাদিসের তত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করার ক্ষেত্রে যুক্তিবাদী চিন্তাধারার স্বীকৃতি দিয়ে তিনি বিশ্বাস করেন যে আহলে হাদিসদের কিছু বর্ণনার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা ভুল। তাদের নীতিগুলির বাহ্যিক ও অভ্যন্তরিন ভাবে ব্যাখ্যা করা উচিৎ।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে, ইমাম খোমেনি আল্লামা মাজলিসির মতামতের সমালোচনা করেন, যা অতিমাত্রায় বলে মনে হয়। একেশ্বরবাদের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রমাণ করার ক্ষেত্রে বর্ণনামূলক দলিলের সাথে লেগে থাকার কোন সীমাবদ্ধতা নেই। ইমাম খোমেনি, এই দাবির সমালোচনা করেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে একেশ্বরবাদ, পুনরুত্থান এবং নবুওয়াতের প্রমাণ যৌক্তিকভাবে প্রমাণিত। যদি কিছু মুহাদ্দিস একেশ্বরবাদ প্রমাণ করার জন্য নকলি দলিলের (উপাখ্যানমূলক প্রমাণের) উপর নির্ভর করে তবে তাদের সর্বশক্তিমান আল্লাহর আশ্রয় নেওয়া উচিত।(২৯)
আল্লামা মাজলিসি হজ থেকে ফিরে আসার সময় নাজাফ আশরাফে বিহারুল আনওয়ারের ২২ খণ্ড লিখেছেন। আর খোরাসান সফর থেকে ফিরার সময় তিনি ইমাম রেজা (আ.)-এর খুতবা ও রিসালায়ে ওজিযে রজবের অনুবাদ সম্পন্ন করেন।
৮.১.২ – আল্লামা মাজলিসি (রহ.)এর অন্যান্য বই
১২ মুলাযিল আখবার ফি শারহিত তাহযিব
৩. শরহে আরবাইন
৪. আল ওজিজা ফীর রাজাল।
৫. আল ফাওয়াইদুত তারিকা ফি শারহিস সহিফাতিস সাজজাদিয়া
৬. রিসালাতুল আল-আওয়াজান ।
৭. আল-মাসাইলুল-হিন্দিয়া।
৮. রিসালায়ে এতেকাদ (৭৫০ লাইন এবং এক রাতে লেখা)
৯. রিসালাতু ফিরশ শুকুক
১০. মিরআতুল উকুল ফি শারহি আখবারির রসুল দার শারহে উসুলুল কাফি
গ্রন্থসূচি:
১৮. শেখ হার আমিলি, আল-আমাল আল-আমাল, খণ্ড ২, পৃ. ২৪৮।
১৯. ইয়াদনামে আল্লামা মজলেসি, পৃ. ২৬।
২০। আমিন, সৈয়দ মোহসেন, আয়ানুশ শিয়া, খণ্ড, ৯, পৃ. ১৮৩।
২১। মাহদাভী, সাইয়্যেদ মোসলেহউদ্দিন, যিন্দেগিনামে আল্লামা মাজলেসি, খণ্ড ১, পৃ. ১১৭।
২২। আতাই খোরাসানী, আলী আসগর, কারনামে আল্লামা মাজলিসি, পৃ. ৫১।
২৩। আতাই খোরাসানী, আলী আসগর, কারনামে আল্লামা মাজলিসি, পৃ. ৫১।
২৪. খোমেনি, রুহুল্লাহ, কাশফুল আসরার, পৃ. ২৫০।
২৫। খোমেনি, রুহুল্লাহ, কাশফুল আসরার, পৃ. ১৬২, ৩১৯, তেহরান, তা.বি।
২৬. খোমেনি, রুহুল্লাহ, তানকিহুল আসুল, ভলিউম ৩, পৃষ্ঠা ৩০-৩১, তেহরান, ইমাম খোমেনি সম্পাদনা ও প্রকাশনা ইনস্টিটিউট, ১৩৭৮।
২৭। খোমেনি, রুহুল্লাহ, আদাবে নামাজ পৃ.২০০, তেহরান, ইমাম খোমেনি সম্পাদনা ও প্রকাশনা ইনস্টিটিউট, ২০০৮।
২৮। খোমেনি, রুহুল্লাহ, তাকরিরাতে ফালসাফায়ে ইমাম খোমেনি, খন্ড, ১, পৃ. ১২৬-১২৭, তেহরান, ইমাম খোমেনির লেখা ও প্রকাশনা ইনস্টিটিউট, ২০০৫।
২৯। খোমেনি, রুহুল্লাহ, দানিশনামায়ে ইমাম খোমেনি খণ্ড, ৮, পৃ. ৪৯৪, তেহরান, ইমাম খোমেনির রচনা সম্পাদনা ও প্রকাশনার ইনস্টিটিউট, ১৪০০।