এস, এ, এ
দুরুদ বা দুরুদ শরিফ (ফার্সি: درود) হলো একটি সম্ভাষণ যা মুসলমানরা নির্দিষ্ট বাক্যাংশ পড়ে ইসলামের শেষ পয়গম্বর মুহাম্মদের শান্তির প্রার্থনা উদ্দেশ্যে পাঠ করা হয়ে থাকে। এটি একটি ফার্সি শব্দ, যা মুসলমানদের মুখে বহুল ব্যবহারের কারণে ১৭শ শতাব্দীতে বাংলা ভাষায় অঙ্গীভূত হয়ে যায়। বৃহত্তর অর্থে মুহাম্মদের প্রতি এবং তাঁর পরিবার-পরিজন, সন্তান-সন্ততি এবং সহচরদের প্রতি আল্লাহর দয়া ও শান্তিবর্ষণের জন্য প্রার্থনা করাই দুরুদ। দুরুদকে প্রায়ই সম্মানসূচকভাবে ইসলামি পরিভাষায় “দুরুদ শরিফ”-ও বলা হয়ে থাকে।
আরবিতে একে সালাওয়াত বলা হয় (আরবি: صَلَوَات, ṣalawāt, একবচন সালাত)। সালাওয়াত হলো সালাত (আরবি: صَلَاة) এর একটি বহুবচন এবং “সোয়াদ-লাম-ওয়াও” (ص ل و) বর্ণসমূহের ত্রিবাক্ষিক মূল স্-ল্-ওয়্ থেকে আগত, যার অর্থ “প্রার্থনা” বা “অভিবাদন”। আরবি দার্শনিকরা মনে করেন যে “সালাওয়াত” শব্দের অর্থ কে ব্যবহার করছে এবং কার জন্য এটি ব্যবহৃত হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে।
সালাত শব্দের অর্থ হলো দুরূদ বা শুভকামনা, তাসবীহ, গুণকীর্তন, রহমত, দয়া, করুণা, ইস্তিগফার বা ক্ষমা প্রর্থনা করা ইত্যাদি। দুরুদ শরীফ এমন একটি সম্ভাষণ যা মুসলমানরা নির্দিষ্ট বাক্যাংশ পড়ে ইসলামের সর্বশেষ নবী মহানবী হযরত মোহাম্মদের (সাঃ) শান্তির প্রার্থনার উদ্দেশ্যে পাঠ করা হয়। রাসূল (সা.) শুধু মানব জাতিই নয় বরং সমগ্র বিশ্ব জাহানের জন্য রহমত স্বরূপ। আল্লাহ সূরা আম্বিয়ার ১০৭ নং আয়াতে বলেন-আমি আপনাকেই শুধুমাত্র সমগ্র বিশ্ব জাহানের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি। যিনি আমাদের জন্য রহমত। তাই প্রতিক্ষণ পাঠকদের জন্য দরূদ পাঠের ফজিলত তুলে ধরা হলো। চলুন জেনে নেই দুরুদ শরীফের ফযিলত।
তাশাহহুদের পর আমাদের নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর উপর দুরূদ শরীফ পাঠ করতে হয়। দুরূদ শরীফ পাঠ করা ছাড়া নামাজ হয় না। তাই আমাদের উচিত বুঝে শুনে শুদ্ধভাবে দুরূদ শরীফ পাঠ করা। নিন্মে দূরুদ পড়ার কিছু ফযিলত উল্লেখ করা হলো:
১। কানযুল উম্মালে ‘হাসান’ থেকে তিনি মহানবী (সাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, বলেন:
أکثِرُوا الصَّلاةَ عَلَيَّ. فَاءنَّ صَلاتَکُم عَلَيَّ مَغفِرَةُ لِذُنُو بِکُم.
আমার প্রতি অধিক দূরুদ পড়; কারণ, আমার প্রতি তোমাদের দূরুদ তোমাদের গুণাহ মাফের উপায় হবে।
২। অনুরূপ আবুদারদা থেকে তিনি রাসূল (সাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন ?
مَن صَلّي عَلَيَّ حينَ يُصبِحُ عَشراً وَ حينَ يُمسي عَشراً أدرَ کَتهُ شَفا عَتي.
যে প্রতি সকাল ও সন্ধ্যায় ১০ বার আমার উপর দূরুদ পড়ে আমার শাফা’অত তাকে স্পর্শ করে।
৩। সাহল ইবনে সা’দ থেকে বর্ণিত হয়েছে :
قَدِمَ رَسُولَ الله () فَاءذا بِأبي طَلحَة, فَقامَ إلَيهِ فَتَلَقّاۀ فَقالَ : بِأ بي اَنتَ وَ اُمّي يا رَسُولَ الله إنّي لَأرَي السُّرُورَفي وَجهِکَ , قالَ()أتاني جبرئيلُ آفاً فقالَ: يا مُحمّد ! مَن صَلّي عَلَيکَ مَرَّ ةً کَتَبَ اللهُ بِها عَشرَ حَسَناتٍ وَ مَحي عَنهُ عَشرَ سَيِّئاتٍ وَرَ فَعَ لَهُ بِها عَشرَ دَرَجاتٍ
রাসূল (সাঃ) প্রবেশ করলে আবু তালহা তাঁর নিকট দ্রুত পৌঁছলেম এবং তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন এবং বললেন: ‘আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গ হোক হে আল্লাহর রাসূল ! আপনার চেহারা আনন্দিত দেখতে পাচ্ছি। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন: জিব্রাইল সবেমাত্র আমার নিকট এসেছিলেন ও বললেন: হে মুহাম্মাদ ! যে কেউ একবার আপনার উপর দূরুদ পড়ে মহান আল্লাহ তাকে দশটি হাসানাহ পুরস্কার দেন, দশটি অপকৃম ও বদ থেকে তাকে মুক্ত করেন এবং তাকে দশ ধাপ উপরে তুলেন।
৪। সহী মুসলিম, সূনানে তিরমিযি, সূনানে নাসাঈ, মুসনাদে আহমাদ এবং এছাড়া আবু হোরায়রা থেকে এসেছে যে: রাসূল (সাঃ) বলেন: مَن صَلّي عَلَيَّ و احِداً صلَّي اللهُ عَلَيهِ عَشراً যে কেউ আমার উপর একবার দূরুদ পড়ে মহান আল্লাহ তার উপর দশবার দূরূদ পাঠান।
৫। কানযূল উম্মালে আম্মার ইয়াসির রাসূল (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে তিনি বলেন:
اِنَّ اللّهَ أعطي مَلَکاً مِنَ الملائکة أسماعَ الخَلق, فَهُوَ قائمُ عَلي قَبري إلي يَومِ القِيا مة لايُصَلّي عَلَيَّ اَحَدُ صَلاةً إلاّ سمّاۀ بِاسمِه وَاسمِ أبيه و قلَ: يا مُحمّد صَلّي عَليک فُلانُ بن فُلان. وَ قَد ضَمِنَ لي رَبِي ـ تَبارَکَ وَ تَعالي ـ انّه أردُّ عَلَيه بِکُلِّ صَلاةٍ عَشرا.
মহান আল্লাহ ফেরেশতাগনের কোন একজন ফেরেশতাকে সমস্ত মানুষের সমান শ্রবণশক্তি দিয়েছে এবং তিনি কিয়ামত দিবস পর্যন্ত আমার কবরে দাঁড়িয়ে আছে। এমন কেউ নেই যে আমার উপর দূরুদ পড়েনা আর তাকে নাম ও পিতার নামে পরিচয় দিয়ে বলেনা: হে মুহাম্মাদ ! অমূকের পুত্র অমূক আপনার প্রতি দূরুদ পাঠিয়েছে । মহান আল্লাহ আমাকে এই কাজে নিযুক্ত করেছেন যে তার প্রতিটি দূরুদের জন্য দশবার তাকে জবাব দিব।সুনানে আবু দাউদ তিরমিযি, নাসাঈ, মুসনাদে আহমাদ ও মুস্তাদরাক ফাযালাত বিন উবাইদ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে তিনি বলেন:
আল্লাহর রাসূল (সাঃ) শুণতে পেলেন এবং ব্যক্তি নামাযে দোয়া পড়ছেন কিন্তু না আল্লাহকে স্মরণ করছে না আল্লাহর পয়গাম্বরের উপর দূরুদ পড়ছে। আল্লাহর রাসূল বললেন: সে তাড়াহুড়া করলো। অতঃপর তাকে ডাকলেন এবং তাকে ও অন্যদেরকে বললেন: যখন তোমাদের কেউ নামায পড়লো সে যেন প্রথমে আল্লাহর হামদ ও সানা পড়ে,অতঃপর আল্লাহর রাসূলের উপর দূরুদ পড়ে। অতঃপর যা ইচ্ছা আল্লাহর নিকট চাইতে পারে।
৭। সা’দ সাঈদী আল্লাহর রাসূল থেকে বর্ণনা করেছেন যে বলেন:
لاصَلاةَ لِمَن لا يُصَلّي علي النَّبي (ص)
যে আল্লাহর রাসূলের প্রতি দূরুদ না পড়লো তার নামায নামায নয়।
৮ । জাবির রাসুলল্লাহ (সাঃ)থেকে বর্ণনাকরেছেন যে, বলেন:
مَن ذُکرتُ عِنرَهُ فَلَم يُصَلِّ عَلَيَّ فَقَد شقي
আমার নাম কারো কাছেউচ্চারণরিত হলো, আর সে আমার উপর দূরুদ পড়লোনা, নিশ্চিত ভাবে সে (আমার প্রতি অত্যাচার করেছে।
৯। ইমাম হুসাইন ইবনে আলী (আঃ) থেকে, তিনি রাসূল (সাঃ) থেকে বর্ণনাকরেছেন যে বলেন:
مَن ذُکِرتُ عِندهُ فخطَئ الصلاةَ عَلَيَّ خَطَئ طَريقَ الحَنَّة
যদি কারো নিকট আমার নাম স্মরণ করা হলো আর সে আমার প্রতি দূরুদ পড়ার ব্যাপরে উদাসীন থাকলো, সে যেন বেহেশতের পথের প্রতি উদাসীন থাকলো।
১০। মুসনাদে আহমাদ ও সূনানে তিরমিযি এবং অন্যান্য কিতাবে হুসাইন ইবনে আলী (আঃ) থেকে তিনি আল্লাহর রাসূল থেকে, বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন:
البَخِيلُ مَن ذُکِرتُ عِندَهُ فَلَم يُصَلِّ عَلَيَّ
১১। সে-ই হলো বখিল (কৃপণ) যার নিকট আমার নাম স্মরণ করা হলো, আর সে আর সে আমার উপর দূরুদ পড়লো না ।
১২। যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ ও তাঁর পরিবারের উপর ১০ বার দুরুদ পাঠ করে, আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ সেই ব্যক্তির উপর ১,০০০ সালাওয়াত পাঠ করেন এবং যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ ও তার পরিবার-পরিজনের উপরে ১,০০০ সালাওত পাঠ করে, জাহান্নামের আগুন তাঁর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
১৩। মুহাম্মাদ ও তাঁর বংশধরের প্রতি দুরুদ পাঠ বিচারের দিন তাঁর সুপারিশের পথ প্রশস্ত করে।
১৪। মুহাম্মাদ ও তাঁর বংশধরকে দুরুদ প্রেরণ পাপের ক্ষতিপূরণ হিসাবে কাজ করে।
১৫। মুহাম্মাদ ও তাঁর পরিবারের প্রতি দুরুদ পাঠ করা কর্মের পাল্লায় সবচেয়ে ভারী কাজ।
১৬। মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর পরিবারের প্রতি দুরুদ পাঠ আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের স্নেহের দিকে পরিচালিত করে।
১৭। মুহাম্মাদ ও তাঁর পরিবারের উপর দুরুদ তাঁর কাজকে বিশুদ্ধ করে।
১৮। মুহাম্মাদ ও তাঁর পরিবারবর্গের উপর দুরুদ ব্যক্তির কবরের জ্যোতি, পুল সিরাত ও জান্নাতের কাজ করবে।
১৯। দুরুদ হৃদয় হালকা করে এবং উন্মুক্ত করে।
২০। দুরুদ শুক্রবারের অন্যতম সেরা আমল।
২১। উচ্চস্বরে সালাওয়াত পাঠ করলে কপটতা বিনষ্ট হয়।
২২। আবু আমামাহ কর্তৃক একটি হাদিস বর্ণনা করা হয়েছে যে মুহাম্মাদ (সা.) বলেন: “প্রতি শুক্রবার আমার উপর আরও দুরুদ পাঠ করুন, আমার উম্মতদের (অনুসারী) কাছে থেকে দুরুদ প্রতি শুক্রবার আমার কাছে পেশ করা হয়। যে ব্যক্তি আমার প্রতি বেশি দুরুদ পাঠ করেছে সে আমার তত বেশি নিকটবর্তী হবে।
২৩। “সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি সে যে তাঁর উপস্থিতিতে আমার নাম উল্লেখ করার সময় আমার নামে দুরুদ পাঠ করে না।
২৪। আল-হাসান বিন আলী থেকে ইবনে আসাকরি বর্ণনা করেছেন, মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন: “আমার উপর আরও দুরুদ পাঠ করো, কারণ তোমার প্রার্থনা তোমার পাপ ক্ষমা হওয়ার পক্ষে উপযুক্ত। এবং আমার জন্য উচ্চ মর্যাদা ও সুপারিশ প্রার্থনা করো, নিশ্চয়ই আমার সুপারিশ আল্লাহর নিকট তোমার পক্ষে প্রার্থনা করবে।
২৫। মুহাম্মাদ থেকে জাফর আল-সাদিক বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: “আল্লাহর নিকট সমস্ত প্রার্থনা আকাশ থেকে আবরিত থাকবে যতক্ষণ না মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর পরিবার-পরিজনের নিকট দুরুদ না পাঠানো হয় (অর্থাৎ তাঁদের নামে দুরুদ না পাঠ করা হয়)।
২৬। জাফর আল-সাদিকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে: “যে ব্যক্তি নবি ও তাঁর পরিবার-পরিজনের উপর দুরুদ পাঠ করে তাঁর অর্থ ‘আমি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি তা নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি যখন আল্লাহ আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, “আমি কি তোমার প্রভু নই?” এবং আমি উত্তর দিয়েছি, “হ্যাঁ আপনি তাই।
২৭। মুহাম্মাদ ও তাঁর পরিবারের প্রতি দুরুদ পাঠ করা একজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দেয়।
২৮। প্রতিনিয়ত দুরুদ পাঠ ব্যক্তির পার্থিব ও স্বর্গীয় ইচ্ছা (প্রার্থনা) পূরণ করে।