Press "Enter" to skip to content

শিয়া সুন্নি মুফাসসিরদের দৃষ্টিকোণ থেকে মুবাহলার আয়াত- পর্ব ২

অনুবাদ: ড. আবু উসামা মুহাররম

পরবর্তি অংশ

মুবাহলার আয়াতটি সংক্ষিপ্তভাবে ব্যাখ্যা করার পর এবং হাদিস ও সুন্নাতের দৃষ্টিকোণ থেকে পরীক্ষা করার পরসংক্ষিপ্তভাবে আমরা এই আয়াতটিকে আহলে বাইত (আঃ) এবং আহলে সুন্নাহ মাযহাবের ভাষ্যকারদের দৃষ্টিকোণ থেকে পরীক্ষা করবো। তারপরে আমরা এর উপর একটি সুন্দর প্রতিবেদন তুলে ধরার প্রয়াস পাবো।

শিয়া মাযহাবের মুফাসসিরদের দৃষ্টিতে মুবাহলার আয়াত

১. শায়খ তুসি (৩8৫-৪৬০ হি) তার তাফসিরে এই আয়াতের নীচে লিখেছেন: “যখন এই আয়াতটি নাযিল হয়, তখন ইসলামের নবি (সা.) আলি, ফাতিমা, হাসান এবং হুসাইন (আ.)-এর হাত ধরেন। তারপর খ্রিস্টান নাজরানদের মুবাহলার জন্য ডাকেন। কিন্তু তারা মুবাহলাকে প্রত্যাখ্যান করে বসে এবং নম্রভাবে জিজিয়া দিতে রাজি হয়।শায়খ লিখেন-

‘এমনকি তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলেছিল: যদি আমরা তাদের সাথে মুবাহলা করি, তাহলে বিচার দিবসে সেখানে কোন খ্রিস্টান পুরুষ বা মহিলা অবশিষ্ট থাকবে না।’।

২. শায়খ তাবারসি (মৃত্যু ৫৪8 হিজরি) একই আয়াতের তাফসিরে লিখেছেন: “এই আয়াতটি নাজরানের খ্রিস্টান দল সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছিল যারা নবি(সা.)-কে পিতা ছাড়া ঈসা (আঃ)-এর জন্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিল।নবির(সা.) উত্তর প্রদানের পর তারা ইসলাম গ্রহণ করেননি।নবি তাদেরকে মুবাহলার জন্য ডাকলেন এবং পরের দিন তিনি আলি বিন আবি তালিব, হাসান, হুসাইন এবং ফাতিমাকে নিয়ে আসলেন। শায়খ লিখেন- ‘কিন্তু তারা মুবাহলা প্রত্যাখ্যান করে এবং জিজিয়া প্রদানে সন্তুষ্ট হয়’।

৩. শায়খ আবুল ফাতহ রাযি (মৃত্যু ৫৫৪ হিজরী) তার তাফসিরে মুবাহলার আয়াত নাযিলের তাৎপর্য সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন: কিন্তু নাজরানের খ্রিস্টানরা মুবাহলাহ থেকে ভীত ছিল ও এ থেকে বাাঁচার জন্য অজুহাত দেখিয়েছিল”

৪. সাইয়্যেদ ফজলুল্লাহ (সমসাময়িক মুফাসসির) তার তাফসিরে মুবাহলাার আয়াত নাযিলের মর্যাদা ব্যক্ত করতে গিয়ে ‘নাজরানের খ্রিস্টান এবং ইসলামের নবির মধ্যে আলোচনা এবং তাদের মুবাহলার আহ্বান’ প্রসঙ্গে লিখেছেন: “ইসলামের নবি(সা.) পরের দিন ইমাম আলি, ফাতিমা হাসান ও হুসাইন (আঃ) এর সাথে এসে মুবাহলা প্রস্তুত করেন। শায়খ লেখেন-

‘কিন্তু যখন তারা নবি(সা.) ও তাঁর পরিবারকে দেখেন, তখন তারা মুবাহলার জন্য ক্ষমা চান এবং জিজিয়া প্রদান গ্রহণ করে ফিরে আসেন’।

৫. শেখ নাসের মাকারেম শিরাজী (সমসাময়িক মুফাসসির) মুবাহলার আয়াত নাযিলের গুরুত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে তার তাফসিরে লিখেছেন:

নাজরানের খ্রিষ্টানদের সাথে মুবাহালা করতে গিয়ে মহানবি (সা.) আলি, ফাতেমা, হাসান ও হুসাঈনদের সাথে নিয়ে আসেন।

আহলুস সুন্নাহ মুফাসসিরদের দৃষ্টিকোণ থেকে মুবাহলার আয়াত

১. মুহাম্মদ বিন জারির তাবারি (মৃত্যু ৩১০ হি) তার বিখ্যাত তাফসিরে মুবাহলার আয়াত নাযিলের মহাত্মা প্রকাশ করতে গিয়ে লিখেছেন:

“ইসলামের নবি (সা.) নাজরানের খ্রিস্টানদের সাথে আলি, ফাতিমা,হাসান ও হোসাইন (আঃ)-এর সাথে মুবাহলার জন্য এসেছিলেন এবং মুবাহলার জন্য প্রস্তুত হন। কিন্তু তারা নবির সাথে সন্ধি করেন এবং জিজিয়া দিতে সম্মত হন।’

২. নাসর বিন মুহাম্মদ সমরকান্দি (মৃত্যু ৩৭৫ হিজরি) তার তাফসিরে লিখেছেন: “ইসলামের নবি (সা.) তাদের [নাজরানের খ্রিস্টানদের] মুবাহলার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এবং তিনি আলি, ফাতিমা, হাসান এবং হুসাইন (আ.)-এর সাথে মুবাহলার জন্য আসেন। কিন্তু তারা তা করতে অস্বীকার করে। এ সময় রাসুল (সা.) তাদের বললেনঃ

‘হয় ইসলাম গ্রহণ কর অথবা জিজিয়া দাও। তারা জিজিয়া দিতে রাজি হয়ে ফিরে গেল। ইসলামের নবি(সা.) বলেছেন: যদি তারা মুবাহালা করতো তবে তারা সবাই ধ্বংস হয়ে যেতো, এমনকি তাদের দেয়ালে বসা চড়ুই পাখিরাও’।

৩. ফখর রাযি (৫৪৪-৬০৪ হি) তার তাফসিরে মুবাহালা বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা প্রদানের পর লিখেছেন: “নাজরানের খ্রিস্টানরা তাদের অজ্ঞতার জন্য জোর দেওয়ার পরেইসলামের নবি (সা.) তাদের মুবাহলাহতে ডেকেছিলেন। আলি, ফাতিমা, হাসান ও হোসাইন (আ.)রাসুল (সা.) এর সাথে ছিলেন। তাদের তিনি বলেছিলেন যখন আমি কোন দোয়ার বাক্য ব্যবহার করবো, তখন তোমরা আমিন বলবে। নাজরানের বিশপ বললেনঃ হে খৃষ্টানগণ! আমি এমন চেহারাগুলো দেখছি যে তারা যদি আল্লাহকে পাহাড় সরাতে বলে, তাহলে [পাহাড়] সরানো হবে। তাদের সাথে ঝামেলা করবে না; কারণ তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে এবং কেয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে কোনো খ্রিস্টান অবশিষ্ট থাকবে না। তারা তখন জিজিয়া দিতে রাজি হয়। ইসলামের নবি(সা.) বললেন:

‘যদি তারা মুবাহলা করে তবে তারা বানর ও শুকরে পরিণত হবে… এবং আল্লাহ নাজরান এবং এর লোকদের এমনকি তাদের ডালে বসা পাখিদেরও ধ্বংস করবেন।’

ফখর রাযি আরও বলেন:

و روی انه علیه السلام لما خرج فی المرط الاسود، فَجَاءَ الحَسَنُ بنُ عَلِيٍّ فأدْخَلَهُ، ثُمَّ جَاءَ الحُسَيْنُ فَدَخَلَ معهُ، ثُمَّ جَاءَتْ فَاطِمَةُ فأدْخَلَهَا، ثُمَّ جَاءَ عَلِيٌّ فأدْخَلَهُ، ثُمَّ قالَ: {إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا}

“নবি(সা.) যখন মুবাহালার উদ্দেশ্যে বের হলেন, তখন আল-হাসান (আ.) প্রবেশ করলেন, তারপর আল-হুসাইন (আ.) এলেন, তারপর তিনি প্রবেশ করলেন, তারপর ফাতিমা (আ.) তারপর আলি (আ.) আসলেন।তারপর তিনি নিম্নেক্ত  আয়াত পাঠ করলেন-

انما یرید الله لیذهب عنکم الرجس اهل البیت و یطهرکم تطهیراً.

বর্ণনা করা হয়েছে যে, ইসলামের নবি(সা.) একটি কালো পশমী আবায়া পরিধান করে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন, হাসান (আঃ) এসে তা তাঁর আবায়ার ভিতরে প্রবেশ করলেন এবং তারপর হুসাইন (আঃ) এসে তাঁকে তাঁর আবায়ার নীচে আসলেন তারপর আলি এবং ফাতিমা (আঃ) আসলেন এবং তারপর নবি(সা.) বললেন: “আল্লাহ কেবল চান আহলে বাইত তোমাদের থেকে অপরিচ্ছন্নতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।”

এই বর্ণনাটি বর্ণনা করার পর, ফখর রাযি লিখেছেন:

واعلم ان هذه الروایة کالمتفق علی صحتها بین اهل التفسیر و الحدیث؛

“জেনে রাখুন যে এই বর্ণনার সত্যতা সম্পর্কে মুফাসসির ও মুহাদ্দিস আলেমদের মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে।”

৪. আবু আল-ফিদা ইসমাইল বিন কাছির দামাসকি (মৃত্যু ৭৭৪ হিজরি) তার তাফসিরে লিখেছেন: কিছু খ্রিস্টান ইসলামের নবি (সা.)-এর কাছে এসে ঈসা (আ.) সম্পর্কে তাঁর কাছে জানতে চায়,

যখন ইসলামের নবি(সা.) তাদেরকে মুবাহলার জন্য ডাকেন, তখন আলি, ফাতিমা, হাসান ও হোসাইন (আঃ) এর সাথে এসেছিলেন।কিন্তু তারা মুবাহলা প্রত্যাখ্যান করে এবং জিজিয়া দিতে রাজি হয়।

৫. আবদুল্লাহ ইবনে উমর বেইজাভী (মৃত্যু ৭৯১ হিজরি) তার তাফসিরে মুবাহলাহ আয়াতের অধীনে লিখেছেন: “ইসলামের নবি (সা.) নাজরানের খ্রিস্টানদের সাথে মুবাহলা করার জন্য আলি, ফাতিমা, হাসান এবং হুসাইন (আ.) কে তার সাথে নিয়ে এসেছিলেন। তাদের তিনি বললেন: আমি যখন প্রার্থনা করি তখন আমীন বলবে। তাদের বিশপ বললেন:

হে খ্রিস্টানরা, আমি দেখতে পাচ্ছি যে তারা যদি আল্লাহকে পর্বত সরাতে বলে, তাহলে  [পর্বত] সরানো হবে। তাদের সাথে ঝামেলাকরবে না। তা না হলে ধ্বংস হয়ে যাবে। তখন তারা জিজিয়া দিতে রাজি হয়। ইসলামের নবি(সা.) বলেছেনঃ সেই আল্লাহর শপথ যার হাতে আমার জীবন, যদি তারা তা করত তবে তারা বানর ও শূকর হয়ে যেত… নাজরান এবং এর মানুষ এমনকি ডালে বসা পাখিরাও। তাদের গাছগুলো নষ্ট হয়ে যেত।

এরপর তিনি  বলেন: (و هو دلیل علی نبوته و فضل من أتی بهم من اهل بیته)  এটি [ঘটনা ও বর্ণনা] [ইসলামের নবির নবুওয়াতের প্রমাণ এবং তার সাথে থাকা আহলে বাইতের যারা মুবাহলাহতে এসেছিলেন তাদের শ্রেষ্ঠত্ব ও গুণের একটি প্রমাণ]।

পর্যালোচনা এবং সংক্ষিপ্ত মতামত

আহলে বাইত এবং আহলে সুন্নাহ মুফাসসিরদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমাদের সারসংক্ষেপ নিম্নরূপ:

১. আহলে বাইত (আ.) এবং সুন্নিদের মুফাসসিররা সবাই ইসলামের নবি (সা.) আলি বিন আবি তালিব (আ.), ফাতিমা যাহরা, ইমাম হাসান এবং ইমাম হোসাইন (আ.)-কে মুবাহলা আয়াতের উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করেন এবং তাদের কেউই অন্য কাউকে এই বিষয়ে অংশীদার হিসাবে বিবেচনা করে না।

২. শিয়া সুন্নির সকল মুফাসসিরগণ মুবাহলাহ আয়াত সম্পর্কে তাদের মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রেওয়ায়েত ও হাদিসের উপর নির্ভর করেছেন এবং প্রায় রেওয়ায়েত ও হাদিসের উপর ভিত্তি করে তাদের মতামত প্রকাশ করেছেন।

৩. তাদের মধ্যে কেউ কেউ (আবদুল্লাহ ইবনে উমর বায়দাভী) আহলে বাইত (আ.)-এর ফজিলত ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ হিসেবে মুবাহলাহ আয়াতটি উপস্থাপন করেছেন এবং এই বিষয়টিকে স্পষ্ট করেছেন।

চতুর্থ অংশ: মুবাহলাহ আয়াত সম্পর্কিত সন্দেহ, অস্পষ্টতা ও প্রশ্নের সমালোচনা ও গবেষণা

শেষ তিনটি বিভাগে যা আলোচনা করা হয়েছে তাতে আলে আবা(আ.)-এর পাঁচজন ব্যক্তিকে মুবাহলারআয়াতেঅংশীদার হওয়ার উপর জোর দেওয়ার বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত ছিল। এতদসত্ত্বেও, মুবাহলাহ আয়াত সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন ও সন্দেহ উত্থাপিত হয়েছে, যা আমরা এই বিভাগে পর্যালোচনা করব।

চলবে…..