হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর তসবিহ
এস, এ, এ
তসবিহ অর্থ প্রশংসা করা। শব্দটি আরবি মূল ‘سَبَحَ’সাবাহা থেকে উদ্ভূত। আরবিতে একে তাসবিহে মুসাবাহ বলা হয়। তাসবিহ বলতে আমরা ” ٱللَّٰهُ أَکْبَرُ” বা ” ٱلْحَمْدُ لِلَّٰهِ” ” سُبْحَانَ ٱللَّٰهِ”, لَا إِلَٰهَ إِلَّا ٱللَّٰهُ”; বুঝি যা এখন তসবিহ নামে পরিচিত। ” سُبْحه” যার অর্থ সেই পুঁতি যা দিয়ে জপমালার সংখ্যা গণনা করা হয়। আর তাসবিহ শব্দটি তাসবিহ, তামজিদ ও তাকবিরের সংখ্যা গণনা করার জন্য সু-প্রসারিত পুঁতি অর্থে ব্যবহার করাকে ফার্সি ভাষায় এটিকে অন্য অর্থে গণ্য করা হয়, যা এর ব্যাপকতা ও ব্যাপক ব্যবহারের কারণে এই অর্থে বিবেচনা করা হয়।
তসবিহ হয়রত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) ইশনা আশআরী অনুসারীদের অতি সম্মানিত একটি বিষয়। কেননা রাসুল (সা.) হযরত ফাতিমা (সা.আ.)কে সকল সমস্যাবলিকে সমাধান এবং সহজ করার জন্য এই তসবিহ-এর শিক্ষা দেন। যদি এর চাইতে উত্তম কিছু থাকতো তাহলে রাসুল (সা.) তা ফাতিমা (সা.আ.)কে শিখিয়ে দিতেন।
তসবিহ ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর ইতিহাস:
হযরত আলী (আ.) বলেন: যখন ঘরের কাজ করা হযরত ফাতিমা (সা.আ.)-এর জন্য কষ্টকর হয়ে যেত এবং ইমাম আলী (আ.) এমন অবস্থা দেখে হযরত ফাতিমা (সা.আ.)কে পরামর্শ দিতেন তিনি যেন রাসুল (সা.)-এর কাছে যায় এবং একজন খেদমতকারের পাঠনোর অনুরোধ করে যেন সে তার বাড়ির কাজ কর্ম করতে তাঁকে সাহায্যে সহযোগিতা করবে। [আসরার ওয়া আসারে তসবিহে হযরত যাহরা (সা.আ.), পৃষ্ঠা ১৮]
হযরত ফাতিমা (সা.আ.) এই বিষয়টি সম্পর্কে রাসুল (সা.)কে অবগত করেন।
রাসুল (সা.) বলেন: হে ফাতিমা! আমি তোমাকে এমন একটি বিষয়ের শিক্ষা দিব যা একজন খাদেম এবং পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে উত্তম, নামাজের পরে ৩৪বার আল্লাহু আকবার, ৩৩বার আলহামদুলিল্লাহ, ৩৩বার সুবহান আল্লাহ এবং সব শেষে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করবে। এই আমলটি পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে উত্তম এবং ভাল। [কাফি, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৩৪২]
তখন রাসুল (সা.)এই আসমানী উপহারটি হযরত ফাতিমা (সা.আ.)কে দান করেন। তখন ফাতিমা (সা.আ.) বলেন: “رَضِیتُ عَنّ اللَّه وَ عَن رَسُولُه”আমি আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের প্রতি সন্তুষ্ট হলাম। [মান লা ইয়াহ যারুহুল ফাকিহ, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৫০২]
তসবিহ ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর গুরুত্ব:
তসবিহ ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) সম্পর্কে একাধিক রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে যেমন: প্রত্যেক পান্জেগানা ওয়াজিব নামাজের পরে পাঠ করার জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এবং প্রসিদ্ধ তাকিবাতের মধ্যে গণনা করা হয়েছে।
ইমাম বাকির (আ.) তসবিহ ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)কে আল্লাহকে স্মরণের জন্য উত্তম উপমা মনে করতেন।
তসবিহ ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর ফযিলত:
ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.)কে জিজ্ঞাসা করা হলো: অল্প পরিমাণ কিন্তু অধিক যিকিরের সওয়াব কিভাবে অর্জন করব? ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.) বলেন: প্রত্যেক নামাজের পরে ত্রিশবার তসবিহ পাঠ করা। [কুরবুল আসনাদ, পৃষ্ঠা ১৬৯]
ইমাম (আ.)-এর উদ্দেশ্যে ছিল তসবিহ ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) পাঠ করা। [কাফি, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৫০০]
অর্থাৎ নামাজান্তে কেউ যদি তসবিহ ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) পাঠ করে তাহলে সে আল্লাহকে অধিক স্মরণ করল।
ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত হয়েছে: আল্লাহ্র প্রদত্ত প্রতিটি হুকুমের একটা সীমা আছে এবং যখন কোন অজুহাত থাকে তখন তা বাতিল হয়ে যায়, শুধুমাত্র আল্লাহ্র স্মরণ ব্যতীত, যা সীমাবদ্ধতা নেই এবং তা ত্যাগ করার অজুহাতও নেই। [জামেউল বায়ান ফি তাফসীরিল কোরআন, খন্ড ২২, পৃষ্ঠা ১৩]
ইমাম বাকির (আ.) বলেন: ফাতেমা যাহ্রা (সা.)-এর তসবিহ্-এর ঊর্ধ্বে কোনো কিছুর মাধ্যমে সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপাসনা করা হয়নি এবং এর চেয়ে উত্তম কিছু থাকলে আল্লাহর রাসূল (সা.) তা ফাতিমা (সা.আ.)-কে শিক্ষা দিতেন। [তসবিহে ফাতিমা যাহরা , পৃষ্ঠা ১০]
গুনাহ মার্জনা:
ইমাম সাদিক্ব (আ.) বলেন: প্রত্যেক ওয়াজিব নামাজের পরে তসবিহ ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) পাঠ করা আমার কাছে প্রতিদিন হাজার রাকাত নামায পড়ার চেয়ে অধিক প্রিয়।
কেউ যদি পান্জেগানা নামাজ শেষে উঠার পূর্বে তসবিহ ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) আল্লাহ তার গুনাহসমূহকে ক্ষমা করে দিবেন। [সাওয়াবুল আমাল, পৃষ্ঠা ৩৬৪]
বেহেশতের সুসংবাদ:
ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.) বলেন: কেউ যদি প্রত্যেকদিন ওয়াজিব নামাজে তাশাহুদ ও সালামের পরে তসবিহ ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) পাঠ করে তাহলে আল্লাহ বেহেশতে তার জন্য ওয়াজিব করে দিবেন। [ফালাহুস সায়েল, পৃষ্ঠা ১৬৫]
শয়তান বিতাড়িত হয়:
ইমাম বাকির (আ.) বলেন: কেউ যদি তসবিহ ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) পাঠ করার পরে আসতাগফিরুল্লাহ পাঠ করে তাকে ক্ষমা করা হবে এবং এই তসবিহ হচ্ছে ১০০ বার কিন্তু এর সওয়াব রয়েছে এক হাজার, তার কাছ থেকে শয়তান দূরে থাকবে এবং সে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করবে। ওয়াসায়েলুশ শিয়া, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ১০২৩, হাদীস নং ৩]
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেছেন: যখন মানুষ ঘামাতে যায় তখন ফেরেশতা ও শয়তান তার কাছে আসে এবং ফেরেশতা তাকে বলে তুমি তোমার দিনটি ভালভাবে শেষ কর এবং রাত্রিকে মঙ্গলের সাথে শুরু কর এবং শয়তান তাকে বলে তুমি তোমার দিনটি গুনাহের সাথে শেষ কর এবং রাত্রিকে গুনাহের সাথে শুরু কর। এমতাবস্থায় যদি মানুষ ফেরেশতার অনুসরণ করে এবং ঘুমানোর পূর্বে তসবিহ ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) পাঠ করে তখন ফেরেশতারা শয়তানকে বিদূরিত করে এবং তাকে ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া পর্যন্ত রক্ষা করে, তারপরেও শয়তান তার কাছে আসে এবং তাকে গুনাহ করার জন্য উৎসাহিত করে এবং ফেরেশতা তাকে ভাল কাজের পরামর্শ দেয়। যদি সে তসবিহ ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) পাঠ করে তাহলে ফেরেশতা তার কাছ থেকে শয়তানকে বিতাড়িত করে এবং আল্লাহ তায়ালা তাকে সারা রাত ইবাদতের সমপরিমাণ সওয়াব তার আমলনামায় লিখে দেন। [শয়তান দুশমানে দিরিনে ইনসান, পৃষ্ঠা ১৩৬]
দুঃখ ও দুর্দশা থেকে পরিত্রাণ:
ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.) বলেন: হে হারুনের পিতা! আমরা যেমনভাবে বাচ্চাদেরকে নামাজের জন্য নির্দেশ দেই অনুরূপভাবে তসবিহ ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) পাঠ করার জন্য নির্দেশ দেই। তুমিও এই বিষয়ে অধ্যবসায় কর; যেন তারা কখনওই দুঃখ ও দুর্দশায় নিপতিত না হয়। [ফুরুয়ে কাফি, কিতাবুস সালাত, পৃষ্ঠা ৩৪৩,হাদীস নং ১৩]
হযরত ফাতেমার তসবিহ পাঠের শর্ত ও নিয়মাবলি:
হজরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর তাসবীহ প্রত্যেক সালাতের পর পাঠ করা মুস্তাহাব (ফরয বা মুস্তাহাব), কিন্তু সকালের নামাযের পর তা পাঠ করা মুস্তাহাবে মোয়াক্কাদা।
হজরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর তসবিহ পাঠ করার সময় কয়েকটি বিষয়ে মনোযোগি হওয়া উচিত।
১. তসবিহর যিকরের তারতিবের প্রতি লক্ষ্য রাখা: ৩৪বার আল্লাহু আকবার, ৩৩বার আলহামদুলিল্লাহ, ৩৩বার সুবহান আল্লাহ পাঠ করা।
২. তসবিহ পাঠের সময় হৃদয় এবং আধ্যাত্মিক মনোযোগের উপস্থিতি।
৩. তসবিহ পাঠের সময় মাওয়ালাতের [এমন কোন কাজ না করা যেন সেই কাজের জন্য যিকিরের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি না হয় ] প্রতি দৃষ্টি রাখা।
৪. নামাজেন্তেই কোন শারিরিক পরিবর্তন ব্যাতিত তসবিহ পাঠ করা। [আহকাম ওয়া নুকতেহায়ে হয়রত যাহরা, পৃষ্ঠা ৪১]
এই প্রসঙ্গে ইমাম বাকির বলেন: “সর্বশক্তিমান আল্লাহর কোনো প্রশংসা করা জন্য ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর তসবিহ-এর ন্যায় আর যদি উত্তম কিছু থাকত, তাহলে আল্লাহর রাসূল (সা.) তা ফাতিমা (আ.)-কে দিতেন।
অনুরূপভাবে নির্ভযোগ্য বর্ণনা অনুযায়ী মহানবী (সা.) থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে: যে ব্যক্তি হযরত ফাতিমা যাহরার (সা.আ.)-এর তাসবীহ নামাজান্তে পাঠ করে এবং তারপর আসতাগফিরুল্লাহ পাঠ করে, তার একশত যিকিরের কারণে ক্ষমাশীল আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন এবং তার আমলনামায় এক হাজার নেকি লিখে দেন এবং শয়তানকে বিদূরিত করেন সে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে। অনুরূপভাবে সহীহ সনদের বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.) হতে বর্ণিত হয়েছ যে, কেউ যদি নামাজান্তে তসবিহে ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) পাঠ করে তাহলে নামাজের স্থান থেকে উঠার পূর্বেই তার গুসাহসমূহকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে এবং তার জন্য বেহেশত ওয়াজিব হবে।
ইমাম মাহদী (আ.ফা.) নামাজান্তে তসবিহ সম্পর্কে বলেছেন: ওয়াজিব নামাজের পরে দোয়া এবং তসবিহ পাঠ করা হচ্ছে মুস্তাহাব নামাজের পরে দোয়া ও তসবিহ পাঠ করার ন্যায় মুস্তাহাব যেমনটি ওয়াজিবের পরে মুস্তাহাবের ফযিলত রয়েছে।
তসবিহে ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর ফযিলত সম্পর্কে ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.) বলেছেন: কেউ যদি ওয়অজিব নামাজের পরে তসবিহে ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) পাঠ করে তাহলে সে নামাজের বসার অবস্থান পরিবর্তন করার পূর্বে তার গুনাহসমূহকে ক্ষমা করা হবে।
অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে কেউ তসবিহে ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) পাঠ করলো সে আল্লাহকে অধিক স্মরণ করলো।
একদা হারুনের সাথে ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.)-এর সাক্ষাত হলে তিনি বাচ্চাদেরকে তসবিহ পাঠের শিক্ষা সম্পর্কে বলেন: হে আবা হারুন! আমরা বাচ্চাদের যেভাবে ওয়াজিব নামাজের জন্য নির্দেশ দেই অনুরূপভাবে তসবিহে ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর জন্যও তাদেরকে পরামর্শ দেই। তুমিও এই বিষয়ে অধ্যবসায় কর। কেননা যে কেউ তসবিহে ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর অধ্যবসায় করবে সে পরকালে পরিত্রাণ লাভ এবং সাফল্যতা অর্জন করবে।
অন্য এক বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম (আ.) তসবিহে ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)কে মুস্তাহাব নামাজের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন: প্রতিদিন নামাজের পর হজরত ফাতেমার তাসবীহ, আমার কাছে প্রতিদিন হাজার রাকাত নামাজের চেয়েও বেশি প্রিয়।
ইমাম হাদী (আ.) বলেন: আমরা আহলে বাইত (আ.)গণ প্রত্যহ ঘুমানোর পূর্বে দশটি কাজ সম্পাদন করি তন্মধ্যে একটি হলো অযু এবং অপরটি হলো তসবিহ পাঠ করা।
তসবিহে ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) সম্পর্কে ইমাম (আ.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, তসবিহটি পাঠ করলে ব্যর্থ এবং নিরাশ না হওয়া, শয়তান থেকে দূরে থাকা, কানে কম শোনা, আমলের পাল্লা ভারী হয়, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায় এবং বেহেশত অর্জন করা যায়।
কারবালার মাটির তসবিহ-এর ফযিলত:
ইমাম মাহদী (আ.ফা.) কারবালার মাটির তৈরি তসবিহ-এর ফযিলত সম্পর্কে বলেছেন: যে ব্যক্তি ইমাম হুসাইন (আ.)-এর তসবিহ ধারণ করে এবং যিকির করতে ভুলে যায়, তাকে তসবিহের যিকিরের সমপরিমাণ সওয়াব দান করা হবে।
ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.) বলেছেন: কারবালা মাটির তসবিহ দ্বারা যিকর পাঠ করলে একবার যিকিরের বিনিময়ে তাকে ৭০বার যিকিরের সমপরিমাণ সওয়াব দান করা হবে এবং কেউ যদি কারবালার মাটির তসবিহ ধারণ করে এবং যিকির ব্যাতিত তসবিহর দানা নিয়ে নাড়াচাড়া করে তাহলেও তাকে প্রত্যেক দানার বিনিময়ে সাতবার তসবিহ পাঠের সমপরিমাণ সওয়াব দান করা হবে।
অন্য রেওয়ায়েতের বর্ণনা অনুযায়ী কারবালার মাটির তসবিহর প্রত্যেকটি দানার বিনিময়ে চারটি সওয়াব দান করা হবে।
বেহেশতের হুরগণ যখন অন্যান্য ফেরেশতাদেরকে পৃথিবীর বুকে অবতরণ করতে দেখে তখন তাদেরকে বলে আমাদের জন্য কারবালার মাটি বা তসবিহ নিয়ে এসো।