Press "Enter" to skip to content

হযরত ফাতেমার (আ.) শাহাদত ও আমাদের শিক্ষা

আলী নওয়াজ খান

আহলে বাইত (আ.)এর প্রেমিকদের কাছে ১৩ই জামাদিউল আওয়াল থেকে ৩ জামাদিউস সানী মা ফাতেমার (ছা.) শাহাদত দিবস উপলক্ষ্যে বিশেষ শোকের দিন। কেননা কোনো কোনো রেওয়াতে বর্ণিত হয়েছে মহানবীর (স.)পরলোক গমনের পর মা ফাতেমা (ছা.) ৭৫ দিন জীবিত ছিলেন আবার কোনো কোনো বর্ণনায় ৯৫ দিনের কথা এসেছে আর এ জন্যই আহলে বাইত প্রেমিকগণ ১৩ই জামাদিউল আওয়াল থেকে ৩ জামাদিউস সানি বিশ দিন মা ফাতেমার (ছা.) শাহাদত দিবস উপলক্ষ্যে শোক পালন করে থাকেন।

হযরত ফাতেমা (ছা.) ছিলেন বিশ্বের সকল মুমিন ও মোমেনার জননী কেননা মহানবী (স.) বলেছেন: আমি ও আলী এই মুসলিম উম্মতের পিতা। তাই নবী পত্নীগণ ও হযরত ফাতেমা (ছা.) মুসলিম উম্মাহর জননী।

মা ফাতেমা (ছা.) পরকালে তাঁর অনুসারীদেরকে শাফায়াত করবেন এবং তিনি হলেন খাতুনে জান্নাত; হাদীসের এই কথাগুলোই আমাদের জাতিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নীচের এই কবিতায় ফুটে উঠেছে।

বিশ্ব দুলালী নবী নন্দিনী

খাতুনে জান্নাত ফাতেমা জননী

মদিনা বাসিনি পাপও তাপও নাসিনী

উম্মতও তারিনী আনন্দীনি

বিশ্ব দুলালী নবী নন্দিনী

খাতুনে জান্নাত ফাতেমা জননী

সাহারা বুকে মাগো তুমি মেঘমায়া

তপ্ত মরুরবুকে স্নেহতরূ ছায়া

মুক্তি লভিল মাগো তব সুখও পরসে

বিশ্বের জত নারী বন্দীনি

বিশ্ব দুলালী নবী নন্দিনী

খাতুনে জান্নাত ফাতেমা জননী

অতএব বিশ্বের সকল মুমিন ও মোমেনার জননী, শাহীদাহ্ যার জীবন ছিল অলৌকিকত্বে ভরপুর, সেই ঐশী নারীর পিতা ছিলেন সৃষ্টি জগতের শ্রেষ্ঠ অস্তিত্ব রাহমাতুল লিল আলামীন, যাঁর সন্তানদ্বয় ইমাম হাসান (আ.) ও ইমাম হোসেন (আ.) বেহেস্তবাসী যুবকদের র্সদার, যিনি নিজেই বেহেস্তবাসী নারীকুলের সম্রাজ্ঞী যাঁকে সৃষ্টি না করলে আল্লাহর রব্বুল আলামীন কোন কিছুই সৃষ্টি করতেন না। তাঁর শাহাদত ও ক্ষনিকের এ জীবনের মধ্যে রয়েছে আমাদের জন্য অনেক শিক্ষা । তাই আজ যদি আমরা মা ফাতেমার (আ.) জীবনাদর্শ থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজ জীবন র্চচা করতে পারি তাহলে মহানবীর আর্দশের আলোতে আমাদের ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন ও সামাজিক জীবন আলোকিত হয়ে উঠবে ।

মা ফাতেমা (ছা.) এর শাহাদতের মধ্যে যে গুপ্ত রহস্যগুলো লুকিয়ে রয়েছে যা ব্যক্তি, পারিবার ও সামাজিক জীবনগঠনের মুলশক্তি হিসেবে পরিচিত আজ আমরা এখানে সে বিষয়গুলো নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করবো।

মা ফাতেমা (আ.) বিশ্ববাসীর কাছে একটি নিরব প্রশ্ন রেখে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছেন। যে প্রশ্নটির মধ্যে আমাদের প্রত্যেকের জন্যে অনেক শিক্ষার বিষয় রয়েছে। আর এ শিক্ষা যদি আমরা গ্রহণ করতে পারি তাহলে নিজের পারলৌকিক জীবনসহ পার্থিব জীবন ও আর্দশ সমাজ গড়ার শক্তি খুজেঁ পাব। আর যদি শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হই তাহলে ইতিহাসের দু:খজনক অধ্যায়ের পুর্নাবৃত্তির জাতায় নিষ্পেশিত হবে আমাদের জীবন ও জাতির ভবিষ্যত। ফলে মানবজাতির দুশমন ও ইবলিস শয়তানের রাজত্বের পরিধি বিস্তার লাভ করবে এবং  মুমিন ও মুসলিম সমাজ ধ্বংসের মুখে পতিত হবে।

মুলত: প্রশ্ন হল মা ফাতেমাকে (ছা.) এই অল্প বয়সে জীবন দিতে হল কেন ?

কেন তাঁর গৃহে হানা দেয়া হয়েছিল ?

কেন তিনি অসিয়াত করে গেলেন রাতের আধারেঁ ও গোপন স্থানে যেন তাঁকে দাফন করা হয়?!

মহানবীর (স.) ঐশী মিশন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও সেযুগে যে চক্রটি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল তার প্রমাণ সুরা তওয়ার ১০১ নম্বর আয়াতে মহান প্রতিপালক ফাঁস করে দিয়েছেন । মহান আল্লাহ বলেন :

وَمِمَّنْ حَوْلَكُمْ مِنَ الْأَعْرَابِ مُنَافِقُونَ وَمِنْ أَهْلِ الْمَدِينَةِ مَرَدُوا عَلَى النِّفَاقِ لَا تَعْلَمُهُمْ نَحْنُ نَعْلَمُهُمْ سَنُعَذِّبُهُمْ مَرَّتَيْنِ ثُمَّ يُرَدُّونَ إِلَى عَذَابٍ عَظِيمٍ

“তোমাদের চারপাশে থাকা মরুবাসীদের (আরবদের) মধ্যকার একটি দল হচ্ছে মুনাফিক এবং মদীনাবাসীদের মধ্যেও অনেকে কপটতায় সিদ্ধ। তুমি তাদেরকে চেন না। আমি তাদেরকে চিনি। অচিরেই আমি তাদেরকে দুইবার শাস্তি দেব। পরে তাদেরকে আরও মহাশাস্তির জন্য ফিরিয়ে আনা হবে।”(৯:১০১)

অতএব মহানবীর যুগ থেকেই একটি দল সুসংগঠিত ভাবে মহানবীর ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। যারা মহানবীর পরবর্তিকালে ইসলামের ইতিহাসে মহানবীর আর্দশকে ভুলেগিয়ে একের পর এক মহাবির্পযায় ডেকে এনেছিল এবং বনি সাকীফার ঘটনা, মা ফাতেমার (ছা.) গৃহে আগুন দেয়ার ঘটনাসহ কারবালার ঘটনার মত অতিনিকৃষ্ট ঘটনাসমূহ ইতিহাসে সৃষ্টি করেছিল।যারা মা ফাতেমার (ছা.) সম্পত্তি বাগে ফাদাক ছিনিয়ে নেয়ার মাধ্যমে তারা তাদের নিজেদের নেকাব উন্মোচিত হয়ে ছিল ।

সেই সত্য লুণ্ঠনকারীদেরকে মা ফাতেমা (আ.) তাঁর বিভিন্ন পদক্ষেপ ও ছোট একটি অসিয়াতের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট করে দিয়েগেছেন। তৎকালীন যুগের কপট ও ভন্ড নবীপ্রেমিক যারা গাদীরে খুমে রাসুলের (স.) অসিয়াতকে, মা ফাতেমার (ছা.) বাগে ফাদাককে, আহলে বাইতের (আ.) সম্মানকে পদতলে পিষ্ট করেছিলেন তাদের সকলের মুখোশকে টেনে ছিড়ে ফেলে দিয়েছেন। মা ফাতেমা (ছা.) উন্মুক্ত করে দিয়েছেন তাদের নখরগুলোকে তারা যে কতখানি ভয়নক ও হিংস্র ছিল তা তিনি স্পষ্ট করে দিয়ে গেছেন। ইসলামী ইতিহাসের সেই লুকায়িত চরম সত্যকে মা ফাতেমা (আ.) আমাদের কাছে উন্মোচিত করে দিয়ে গেলেন তাঁর করুন শাহাদতের মধ্য দিয়ে ।

উপরে উল্লেখিত পবিত্র আয়াতটি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে মহানবীর পাশে থাকলেই তিনি আর্দশপুরুষ নন। বরং মহানবীর আর্দশ বা সীরাত অনুসরণের মাধ্যম সাহাবী পরিভাষা সংজ্ঞায়িত হওয়া উচতি। অথচ ইতিহাসে সাহাবী পরিভাষার মিথ্যে সংজ্ঞা দিয়ে মহানবী (স.) আদর্শ বিরোধী ও আহলে বাইত (আ.) শত্রুদের পাপমোচনের অপচষ্টো করা হয়েছে । মা ফাতেমা (ছা.) তাদের অপচেষ্টা ও মহানবীর কপট অনুসারীদের নেকাব খুলে দিয়েছেন। কেননা মহানবীর (স.) অর্বমানে সত্যমিথ্যা নির্ণয়ের একটি বিশুদ্ধ মাপকাঠি ছিলেন হযরত ফাতেমা (ছা.) । কেননা মহানবী (স.) বলেগেছেন: ফাতেমা আমার দেহের অংশ যে তাঁকে কষ্ট দেয় সে আমাকেই কষ্ট দিল আর যে আমাকে কষ্ট দিল সে মহান আল্লাহকে রাগান্নিত করলো।

কিন্তু আফসোস মহানবীর (স.) পরলোক গমনের পর মা ফাতেমার (ছা.) সাথে তথাকথিত সাহাবীদের আচারণের ভিত্তিতে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে কারা মহানবীর (স.) আর্দশের প্রকৃত অনুসারী ছিলেন আর কারা সুবিধাবাদী অনুসারী বা কপট সাহাবী ছিলেন ?

কিন্তু প্রশ্ন হল মদীনায় বসবাসকারী, এত মুসলামান থাকা সত্তেও কেন মা ফাতেমাকে (আ.) শহীদ হতে হল ?!

কেন ইতিহাসের সর্বাধিক শক্তিশালী, জ্ঞানী, আবেদ মানুষ ছিলেন মাওলা আলী (আঃ) তাঁর গলায় দঁড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যাওয়া হল?

কেন জনগণের পক্ষ থেকে আশানুরূপ কোন প্রতিবাদ আসেনি ?!

কেন মা ফাতেমার (আ.) গৃহে যেখানে আল্লাহর ওহী নাযিল হয়েছিল সেখানে আগুন জ্বালা হল ?!

জানি না আমার প্রশ্নগুলো আপনারা বুঝতে পেরেছেন কি না ? প্রকৃত পক্ষে মা ফাতেমা (আ.) নিজেই এপ্রশ্নগুলো আমাদের কাছে উত্তরের জন্যে রেখে গেছেন । তিনি চেয়েছেন তাঁর অনুসারীরা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করবেন।

নি:সন্দেহে আপনারা জানেন যখন মহানবীকে (স.)দাফন না করেই তথাকথিত সাহাবীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভাগাভাগী করতে বনি সাকিফাতে চলেগলেন *তখনই মা ফাতেমা (আ.) মদীনায় প্রত্যেকের বাসায় বাসায় গিয়ে দরজায় কড়া নেড়ে ডেকে বলেছিলেন, তোমরা কি জানো না গাদীরে খুমে আমার বাবা রাসুলুল্লাহ তাঁর উত্তরসুরী মনোনীত করে গিয়েছিলেন? আপনারা কি জানেন না আবুল হাসানকে তাঁর পরর্বতী খলিফা মনোনীত করেগেছেন ? আপনারা কি জানেন না … !

আপনারা কি জানেন সেদিন সদ্য পিতাহারা মা ফাতেমাকে (আ.) তারা কি জবাব দিয়েছিলেন ?!

ওহে উম্মে হাসান ! আমরা কিছু করতে পারবো না, তুমি দেরী করে ফেলেছো, এখন আমাদের আর কিছুই করার নেই !

তুমি ফিরে যাও নতুবা আমরা সমস্যায় পড়বো ! শুধু তাই নয় সেদিন মদীনাবাসী মা ফাতেমাকে (আ.) তাদের কাছে আসতে দেখে ঘরের দরজা , জানালা ঘট ঘট করে বন্ধ করে দিয়েছিলেন যাতে তাঁর করুণ ফরিয়াদ শুনতে না হয় ! মা ফাতেমার (আ.) কাঁন্নার আওয়াজ শুনে কেউই জিঙ্গাসা করতে আসেননি, যে কেন তিনি এত কাঁদছেন?!

তারা জানতেন ইসলামকে বিপদগ্রস্থ দেখেই কাঁদছেন?! এ কাঁন্না  শুধু পিতা হারানোর কান্না নয় ! বরং এপ্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই তিনি কাঁদছেন যে আল্লাহর দ্বীনকে তথাকথিত সাহাবীদের দ্বারা পয়মাল করা হচ্ছে আর তিনি তা রক্ষায় কিছুই করতে পারছেন না !

এটা ছিল ইসলামের ভবিষ্যত ও রাসুলের অসিয়াত ভু-লুন্ঠিত হওয়ার আক্ষেপের কাঁন্না, আর এজন্য তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন একাধারে (এদৃশ্য দেখে) কেঁদে গেছেন !

এর মুল কারণ কি ?

কেন ইসলামী ইতিহাসের প্রথম যুগেই এজাতিয় মহাবির্পযায় ঘটলো ?!

কেন মহানবীর হাতে দীক্ষা লাভকারী মুসলমানরা হঠাৎ করে পিছুটান দিলেন ? কারবালার খুনে রাঙ্গা পথের সূচনা এখান থেকেই ঘটেছিল ! অন্যায়ের মোকাবিলায় দূর্বল ঈমানদারদের নীরবতা জালিমের অপরাধের পথকে সুগম করে দিয়েছিল। সেদিন যদি প্রতিবাদ করে অন্যায়কারীদের রূখে দেয়া হতো তাহলে কারবালার তিক্ত ইতিহাস হয়ত রচিত হত না।

আমরা যদি এর মুল কারণ গুলো চিহ্নিত করতে সক্ষম হই তাহলে মা ফাতেমার (আ.)অবস্থা সর্ম্পকে জানতে পারবো এবং রাসুলের আর্দশ রক্ষায় আমাদের দায়িত্ব কি তা চিহ্নিত করতে সক্ষম হব।

এই চরম হৃদয় বিদারক ঘটনার মুলে তিন শ্রেনী মানুষ ছিলেন চরম অপরাধী। শুধু সেদিনই নয় যুগে যুগে এজাতিয় মানুষদের যথাসময়ে নিজ দায়িত্ব পালন না করার অপরাধের কারণে ধ্বংস হয়েছে বহুজনপদ হারাতে হয়েছে অসংখ্য মহাপুরুষকে, বিনষ্ট করা হয়েছে তাদের মুল্যবান জীবনের শত পরিশ্রম। অতএব এ বিষয়টি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ তাই সকলের মনোযোগ কামনা করছি।

এজাতিয় ঘটনা সৃষ্টির মৌলিক কারণসমূহ :

এক. প্রত্যেক সমাজে এমন কিছু মানুষ থাকেন যারা তাদের চোখের সামনে অন্যায় বা অপরাধমুলক কর্ম ঘটলেও তারা নিষ্ক্রিয় থাকেন। তাদের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে অপরাধীরা অন্যায় কাজের অনুপ্রেরণা পেয়ে থাকে। এলোকগুলো যথাসময়ে সঠিক ভুমিকা পালন করলে অন্যায়কারীরা এতখানি উদ্ধ্যত হতে পারতো না এবং তাদের নীল নকশা মাঠেই মারা যেত। কিন্তু সমাজে বিচক্ষণতার অভাব ও দুনিয়ার মোহ জনগণকে প্রতিরোধের পথে নিস্পৃহা করে দেয় ফলে তারা এক দিক থেকে ইসলামের একটি মুল ফরজ দায়িত্ব, সৎকাজের আদেশ ও অন্যায় কাজের নিষেধ পরিত্যাগ করেন আর অন্যদিকে সমাজে অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করলেন । মহান আল্লাহ এজাতিয় লোকদের প্রতি অভিশাপ দিয়েছেন:

لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُواْ مِن بَنِي إِسْرَائِيلَ عَلَى لِسَانِ دَاوُودَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَلِكَ بِمَا عَصَوا وَّكَانُواْ يَعْتَدُونَ

*বনী ইসরাঈলের মধ্যে যারা কুফরী করেছে তাদেরকে দাঊদ ও মারইয়াম পুত্র ঈসার মুখে লা‘নত করা হয়েছে। তা এ কারণে যে, তারা অবাধ্য হয়েছে এবং তারা সীমালঙ্ঘন করত। ( সুরা মায়েদা- 78)

كَانُواْ لاَ يَتَنَاهَوْنَ عَن مُّنكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُواْ يَفْعَلُونَ

তারা পরস্পরকে অন্যায় কাজে নিষেধ করত না। তারা যা করত, তা কতইনা মন্দ! (সুরা মায়েদা-79)

অতএব সৎকাজের আদেশ ও অন্যায় কাজের নিষেধ যদি কেউ না করে তাহলে সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে এবং আল্লাহ তাদের প্রতি অভিশাপ দেন। তাই প্রতিটি ক্ষেত্রে হিকমাতের সাথে এদায়িত্বটি আমাদের জীবনের সাথে বেঁধে নিতে হবে।

দুই. সমাজের সবাই কিন্তু বে-দ্বীন নয় । কিন্তু কিছু শয়তান লোক তাদের চক্রান্তমুলক অভীসন্ধিকে বাস্তবায়নের জন্য মিথ্যা গুজব ও নানান অপ্রচার করে থাকেন আর এই গুজবের প্রভাবে র্দূবল ইমানের মানুষেরা প্রভাবিত হয়ে একটি ভাল ও আর্দশবান মানুষের প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করতে থাকে এবং ঐ ভুল ধারণাগুলো তারা মনের মধ্যে লালন করতে থাকেন। আর যখনই ঐ যোগ্যলোকটি কোনো চক্রান্তের স্বীকার হয় তখন ঐ র্দূবল ইমানের লোকগুলো ষড়যন্ত্রকারীদের পক্ষে চলে যায়। ফলে আর্দশ মানব হলেও তিনি কঠিন মর্হূতে নি:সঙ্গ ও একাকী হয়ে পড়েন।

আর এজন্য পবিত্র কুরআন বলা হয়েছে :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِّنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَن يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ رَّحِيمٌ

হে মুমিনগণ, তোমরা অনেক সন্দেহ থেকে নিজেকে রক্ষা কর। নিশ্চয় কতক সন্দেহ গোনাহ। এবং কারো গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না। তোমাদের কেউ যেন কারও নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করাকে পছন্দ কর? বস্তুতঃ তোমরা তো একে ঘৃণাই কর। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু। [সুরা হুজুরাত: ১২]

অতএব আমরা অনেক ক্ষেত্রে দেখতে পাই সমাজ সংশোধনের জন্য কেউ অগ্রসর হলেই সমাজের কিছু স্বার্থপর ও হিংসুক মানুষ তার বিরুদ্ধে কুৎসা ও ভিত্তিহীন অপবাদ ছড়াতে থাকে ফলে যারা অপবাদ ছাড়ায় তারা সমাজের কোন উন্নয়ন মুলক কাজ তো করেই না আর যারা করতে চেয়েছিলেন তাকে বাঁধাগ্রস্থ করার ফলে সমাজের উল্লেখযোগ্য কোন উন্নতি হয় না। আর এভাবে ধীরে ধীরে সমাজের মানুষেরা আত্মিক ও নৈতিক দিক থেকে দুরে সরে যায় । ফলে সমাজ অপর্কমে ভরে যায়।

মিথ্যা অপবাদ ও ভিত্তিহীন সন্দেহের কারণে একজন যোগ্য মানুষের ব্যক্তিত্বকে হত্যা করা হয় ফলে সমাজ তার সুফল থেকে উপকৃত হওয়ার সুযোগকে হাতছাড়া করে। আর এজন্যই আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে এতটা অপবাদ দেয়া হয়েছিল যে তিনি যখন মসজিদে শহীদ হলেন তখন এখবর শুনে দামেষ্কের লোকেরা বলতে লাগলো, আলী কি নামায পড়ত ?! তিনি মসজিদে কি করতে গিয়েছিলেন ?!

আর এজন্যেই কুরআন ও হাদিসের দৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় পাপ হল গীবত বা অন্যের ব্যক্তিত্বকে ছোট করার জন্য পরর্চচা করা। অতএব আমাদের কারো উচিত নয় পরনিন্দায় লিপ্ত হওয়া বা কান দেয়া। কেননা এই অপরাধগুলো সমাজকে ধ্বংস করে ফেলে।

তিন. ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার বা নিজ স্বার্থকে রক্ষার জন্য কিছু মানুষ সত্যকে জানার পরও অন্যায়ের পক্ষ অবলম্বন করে থাকেন। অর্থাৎ সত্যের উপর বিপদ অনুভব করলেও পার্থিব স্বার্থের কারণে এগিয়ে আসেন না। এমনকি ব্যক্তি স্বার্থের কারনে অন্যায়কারীদের পক্ষ অবলম্বন করতেও তারা দ্বিধা বোধ করে না। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ হযরত মুসা (আ.)-এর একটি ঘটনা এভাবে তুলে ধরেছেন যে যখন হযরত মুসা (আ.) তাঁর জাতিকে শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রামে যাওয়ার আহবান করলেন তখন তারা আল্লাহর নবীকে বললেন : হে মুসা ! তুমি আর তোমার খোদা যেয়ে যুদ্ধ কর, আমরা এখানে বসে থাকলাম।

قَالُواْ يَا مُوسَى إِنَّا لَن نَّدْخُلَهَا أَبَدًا مَّا دَامُواْ فِيهَا فَاذْهَبْ أَنتَ وَرَبُّكَ فَقَاتِلا إِنَّا هَاهُنَا قَاعِدُونَ

তারা বললঃ হে মূসা, আমরা জীবনে কখনো সেখানে যাব না, যতক্ষণ তারা সেখানে থাকবে। অতএব, আপনি ও আপনার পালনকর্তাই যান এবং উভয়ে যুদ্ধ করে নিন। আমরা তো এখানেই বসলাম। [সুরা মায়েদা: ২৪]

অতএব কোন সমাজ যদি এই তিনপ্রকার নৈতিক রোগে আক্রান্ত হয় সে সমাজ অন্ধকারে তলিয়ে যাবে আলোর মুখ দেখতে পাবে না।

আল্লাহর রাসুল (স.) মাত্র কয়েক মাস পূর্বে বিদায় হজ্জের ভাষণে গাদীরে খুমের ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে ইমাম আলী (আ.)-কে নিজের উত্তরসূরী মনোনীত করে গেলেন। আর পরলোকগমনের সাথে সাথে রাসুলের (স.) সেই উম্মতই মহানবীর অসিয়তকে ফেলে রেখে ভোটাভুটি করতে বনি সাকিফাতে চলে গেলেন কিন্তু কেউই তাদের এই অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করেননি !!!

সবারই পিতা মারা যান এটাই স্বাভাবিক নবী কন্যাও জানতেন। তাই শুধু পিতা হারানোর বেদনায় আমরণ তিনি কেঁদে যাবেন একথা বিশ্বাস করা যায় না। মদীনাবাসীর সবাই জানতেন তিনি কেন কাঁদছেন ? আর এ কারণেই তাদের কেউ শান্তনা দিতেও আসেনি। কেননা তারা বুঝতে পেরেছিল যে নবীপরিবারের উপর আরোপিত অন্যায়ে তাদের ভুমিকা ছিল অপরাধীদের পক্ষে! কি শান্তনা দিবেন তারা ?

উল্লেখিত তিন শ্রেণীর মানুষের প্রতি মহান আল্লাহ ক্রোধান্নিত । আল্লাহ বলেন :

ذَلِكَ بِأَنَّهُمُ اسْتَحَبُّواْ الْحَيَاةَ الْدُّنْيَا عَلَى الآخِرَةِ وَأَنَّ اللّهَ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ

“(আল্লাহর ক্রোধের) কারণ হলো, তারা এই পৃথিবীর জীবনকে পরকালীন জীবনের চেয়ে বেশি ভালবাসে। যারা ঈমান ত্যাগ করে আল্লাহ তাদের হেদায়েত করবেন না।” (১৬:১০৭)

أُولَـئِكَ الَّذِينَ طَبَعَ اللّهُ عَلَى قُلُوبِهِمْ وَسَمْعِهِمْ وَأَبْصَارِهِمْ وَأُولَـئِكَ هُمُ الْغَافِلُونَ (108) لاَ جَرَمَ أَنَّهُمْ فِي الآخِرَةِ هُمُ الْخَاسِرونَ (১০৯)

“এরাই তারা যাদের হৃদয়, কান এবং চোখে আল্লাহ মোহর মেরে দিয়েছেন। তারাই (সত্য সম্পর্কে) উদাসীন।” (১৬:১০৮)

নিঃসন্দেহে তারা পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।” (১৬:১০৯)

মানবসৃষ্টির শুরু থেকেই এই নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলো চিরাচরিত মহান আর্দশ বাস্তবায়নের পথের বাঁধা হিসেবে কাজ করে এসেছে, এবং শেষ পর্যন্ত এই ধারা চলতে থাকবে । আত্মিক উন্নতি ও বুদ্ধিবলে ঐ সব শয়তানী জালের পরিবেষ্টনকে ছিন্ন করতে না পারলে কোন সমাজই আলোকিত ভবিষ্যতের সৃষ্টি করতে পারবে না। তাই যুবসমাজকে আজ সমাজগড়ার তাগীদে প্রতিজ্ঞা করতে হবে সৎকাজের আদেশ ও সৎকাজের পক্ষে থাকার । আর অন্যায়ের সাথে না থেকে অন্যায় কাজে বাঁধা দেয়ায় অঙ্গীকারাব্ধ হতে হবে।

একইভাবে পরনিন্দা ও পরর্চচা থেকে বিরত থেকে সমাজে পরর্চচাকারীদের প্রতি ঘৃণার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। আর ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে র্ধম ও সমাজকে প্রাধান্য দিতে হবে। তবেই আর্দশ সমাজের রূপ আকার স্বপ্ন আমরা দেখতে পাব।

আমরা যদি এই প্রত্যায়গুলো প্রত্যেকে মেনে চলতে পারি তাহলে আলোকিত সমাজ গড়ার পথ আমাদের জন্য সুগম হয়ে আসবে এবং আমাদের সমাজের প্রতিটি মানুষের জীবন হবে আলোকিত জীবন যার পরিণতি হল বেহেস্ত।

বিশ্বের মহাপুরুষগণ এবং মা ফাতেমা (আ.) এই তিন শ্রেণী লোকদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। যার ফলে মা ফাতেমার (আ.) সম্পত্তি বাগে ফাদাক ছিনিয়ে নেয়া হলেও সেদিন কেউ প্রতিবাদ করেনি। কারণ মানুষের মাঝে ন্যায় অন্যায়ের কোন পার্থক্য ছিল না। আর যখন ধর্মীয় স্বার্থের উর্ধ্বে ব্যক্তিস্বার্থ প্রাধান্য পাবে তখন আর মা ফাতেমার (ছা.) মতো মহান ব্যক্তির ডাকেও কেউ সাড়া দেবে না ! পরনিন্দা অপবাদের দৌরত্ম এতবেশী ছিল যে, মহানবীর জামাতা ইমাম আলী (আ.) মসজিদে শহীদ হওয়ার খরবে সিরিয়ার রাজধানী দামেষ্কের লোকেরা বিষ্মিত হয় জিঙ্গেস করতে থাকে আলী কি নামায পড়তেন ? তাহলে মসজিদে কি করছিল ?

যেদিন তথাকথিত মুসলমানরা মহানবীর উত্তসূরীর মাকাম ইমাম আলী (আ.) থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল সেদিনও কেউই রক্ষায় এগিয়ে আসেনি! মা ফাতেমার (আ.)-এর ঘরে আগুন জ্বললেও কোন সাহায্যকারী সেদিন তারা পাননি !

অতএব যদি আমরা চাই ইতিহাসের ঐ নিকৃষ্টতম অধ্যায়গুলো যার কারনে মা ফাতেমা (আ.) থেকে শুরু করে সমস্ত ইমামগণ শহীদ হয়েছেন তার পুর্ণবৃত্তি আর না হোক তাহলে উপরের তিনটি বিষয়ে আমাদের অতিশয় সর্তক হতে হবে। বিবেক এবং বিচক্ষনার ভিত্তিতে পা বাড়াতে হবে সামাজিক কাজে যাতে কেউ সাহস না পায় অতীতের মত অপপ্রচার করে র্ধমীয় ব্যক্তিত্ব বা র্ধমের খাদেমদের চেহারাকে কলঙ্কিত করতে সেদিকে তিক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে।।

মা ফাতেমার (আ.)-এর কবর আজ আমাদের কাছে অজানা রয়েগেছে। তিনি নিজেই চেয়েছেন যে অজানা থাক, তাহলে বোঝেন কতখানি কষ্ট তিনি পেয়েছেন ? একজন মানুষ কখন বলেন যে আমার কবরটি অজানা রেখো ! আমার মনে হয় যখন তিনি দেখেন যে তার সবাই থাকতে কেউই নেই। কেননা, তিনি কাঁন্নার মধ্যে দিয়ে নিজের কাছে মদীনাবাসীদের ডেকে আনার চেষ্টা করেছেন যাতে মানুষেরা এসে তাঁকে প্রশ্ন করেন , কেন বিবি এত কাঁদছেন ? আর তিনি এই সুযোগে ঐ তিন শ্রেণীর মানুষদের খিয়ানতের কথা বলতে পারেন । কিন্তু সেদিন শুধুই যে তাঁর কাছে কেউই আসেনি তাই নয় বরং তারা তাঁকে জনবসতি থেকে বের হয়ে গিয়ে জনবসতিশুন্য এলাকাতে গিয়ে কাঁদতে পরামর্শ দেন ! হায় আফসোস ! হায় আফসোস !

মা ফাতেমার (ছা.) অসিয়াতনামা :

ইমাম আলী (আ.) মা ফাতেমার (ছা.) মাথা কোলের মধ্যে আকঁড়ে ধরে বললেন : হে ফাতেমা তোমার অসিয়াত কর। তুমি যা কিছু অসিয়াত করবে আমি সবই পালন করবো । ফাতেমা (ছা.) বললেন : হে আল্লাহর রাসুলের চাচাতো ভাই আল্লাহ তোমাকে অনন্ত কল্যাণ দান করবেন। …………………………………………………………………………

যারা আমার প্রতি জুলুম করেছে, আমার অধিকার হরণ করে নিয়েছে তারা যেন আমার গোসলের সময় বা জানায়ায় অংশগ্রহন না করেন। কেননা তারা আমার পিতা ও আমার শত্রু । তাদের কেউই যেন আমার জানাযার নামাযে উপস্থিত না হয়। শুধু তারাই নয় বরং তাদের অনুসারী ও সহকারীও যেন না আসে। রাতের বেলা যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়বে তখন আমাকে মাটি দিবে। (এখানে সময়ের অভাবে সংক্ষিপ্ত আকারে অসিয়াত নামাটি আনা হয়েছে)

📚[ বিহারুল আনোয়ার , ৪৩ খন্ড, ১৯ নম্বর পৃষ্ঠা, ২০ নম্বর হাদীস।]

More from হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)More posts in হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) »