এস, এ, এ
আল্লামা মাজলিসি (রহ.) তাঁর “যাদুল মাআদ” নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ৯ ও ১০ মহরম রোজা না রাখা, কেননা উমাইয়ারা এ দু’দিনে ইমাম হুসাইন (আ.)কে হত্যা করার কারণে আনন্দিত হয়, এই দিনকে নিজেদের জন্য বরকতময় এবং আহলে বাইতকে কটাক্ষ করার উদ্দেশ্যে রোজা রেখেছিল। তারা রাসুল (সা.)এর নাম দিয়ে এ দু’দিনে রোজা রাখার ফযিলত সংক্রান্ত অনেক মিথ্যা হাদীস তৈরী করেছে। বণি উমাইয়ারা আশুরার দিন খাদ্য গুদামজাত করাকে নিজেদের জন্য বরকতময় বলে মনে করতো।
যে সকল কারণে বণি উমাইয়ারা এই অশুভ দিনটিকে বরকতময় বলে মনে করে তা নিন্মরূপ:
১. উমাইয়ারা আশুরার দিনে সারা বছরের জন্য খাদ্য গুদামজাত করা মুস্তাহাব এবং তা নিজেদের জন্য রুজি বৃদ্ধি এবং বিলাসিতার কারণ বলে মনে করতো। যদিও আহলে বাইত (আ.) তাদের এ ধারণাকে ভ্রান্ত এবং তা করতে নিষেধ করেছেন।
২. উমাইয়ারা আশুরার দিন ঈদ উৎযাপন করতো। তারা তাদের পরিবার পরিজনদের জন্য নতুন পোষাক, খাদ্য, একে অপরের সাথে সাক্ষাত, কোলাকুলি করা, সাজসজ্জা করা ইত্যাদি বিষয়গুলো নিজেদের অনুসারীরে মধ্যে ধিরেধিরে প্রচলন ঘটায়।
৩. উমাইয়ারা আশুরার দিনে রোজা সম্পর্কে অনেক জাল হাদীস বর্ণনা করেছে।
৪. তারা আশুরার দিনে নিজেদের চাহিদা পূরণের জন্য দোয়া করাকে মুস্তাহাব মনে করতো।
৫. তারা এই দিনে রোজার ফযিলত সম্পর্কে অনেক জাল হাদীস বর্ণনা করেছে, দোয়া লিখেছে এবং তা প্রচার করেছে যেন সাধারণ লোকজন প্রকৃত সত্য থেকে অজ্ঞ থেকে যায়।
সুতরাং তারা বিভিন্ন মসজিদের মিম্বারে, শহরে যে বক্তৃতা দেয় তাতে বর্ণনা করে যে, আশুরা পূর্ববর্তী সকল নবীদের জন্য ছিল মর্দাপূর্ণ যেমন:
– নমরূদের নির্দেশে প্রজ্বলিত আগুন নিভে যায়।
– হযরত নূহ (আ.)-এর নৌকা জুদি পাহাড়ে থামে।
– ফেরাউনের সৈন্যরা নীল নদে ডুবে যায়।
– হযরত ঈসা (আ.) ইয়াহুদীদের চক্রান্ত থেকে পরিত্রাণ পায়।
তাদের বর্ণনা অনুযায়ী উল্লেখিত সকল ঘটনা এ দিনেই সংঘটিত হয়। শেখ সাদুক্ব (রহ.) জাবালে মাক্কি হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন: আমি মিসামে তাম্মার (রা.)কে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহর শপথ! মুসলিম উম্মাহ আশুরার দিন রাসুল (সা.)এর প্রাণ প্রিয় দৌহিত্রকে শহীদ করবে এবং আল্লাহর শত্রুরা সে দিনকে নিজেদের জন্য বরকতময় বলে মনে করবে। কথাটি বলার পরে মিসামে তাম্মার (রা.) কাঁদতে কাঁদতে বলেন: হে জনতা! তারা এমন এক মনগড়া হাদীস জাল করবে যাতে তারা উল্লেখ করবে যে:
– আজকের দিনেই আল্লাহ তায়ালা হযরত আদম (আ.)-এর তওবাকে কবুল করেছিলেন। অথচ প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে যে, আল্লাহ তাঁর তওবাকে জিলহজ্ব মাসে কবুল করেছিলেন।
– তারা বলবে যে, আজকেই হযরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পান। কিন্তু আল্লাহ তাকে জিলক্বদ মাসে মাছের পেট থেকে মুক্তি দান করেছিলেন।
– তারা বলবে যে, আজকের দিনে হযরত নূহ (আ.)-এর নৌকা জুদি পাহাড়ে থামে। কিন্তু সত্য ঘটনা হলো যে, নৌকাটি ১৮ জিলহজ্বে জুদি পাহাড়ে থেমেছিল।
– তারা প্রচার করবে যে, আজকের দিনেই হযরত মূসার (আ.) জন্য নীল নদের পানি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। কিন্তু আসলে ঘটনাটি রবিউল আওয়াল মাসে সংঘটিত হয়েছিল।
মিসামে তাম্মারের এই কথা থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয় তা হচ্ছে নবুওয়াত ও ইমামতের জন্য একটি নিদর্শন স্বরূপ এবং শিয়া মুসলমানদের হক্ব পথে থাকার একটি দলিল স্বরূপ। কেননা হাদীসটিতে এমন কিছু লিখা রয়েছে যা পূর্বে বর্ণিত হয়েছিল এবং পরবর্তিতে তা ঘটছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে, ঘটনাগুলো জাল হওয়ার পরেও লোকজন তা মিথ্যা ধারণা উপরে ভিত্তি করে মেনে নিয়েছে এমনকি দোয়াও রচনা করেছে যা বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।
উপরে উল্লেখিত প্রকৃত সত্য ঘটনা সম্পর্কে সে যুগের লোকেরা অজ্ঞ ছিল। তারা সেই দোয়াগুলো জনগণের কাছে পৌঁছে দেয় যা পাঠ করা বিদআত ও হারাম। ঐ দোয়াসমূহের মধ্যে নিন্মোক্ত দোয়া হলো একটি:
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ، سُبْحَانَ اللَّهِ مِلْءَ الْمِيزَانِ وَ مُنْتَهَى الْعِلْمِ وَ مَبْلَغَ الرِّضَا وَ زِنَةَ الْعَرْشِ.
কয়েকটি লাইন পরে বর্ণিত হয়েছে যে, ১০ বার দুরুদ শরীফ পাঠ করার পরে বলতে হবে:
يَا قَابِلَ تَوْبَةِ آدَمَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ
يَا رَافِعَ إِدْرِيسَ إِلَى السَّمَاءِ يَوْمَ عَاشُورَاءَ
يَا مُسَكِّنَ سَفِينَةِ نُوحٍ عَلَى الْجُودِيِّ يَوْمَ عَاشُورَاءَ
يَا غِيَاثَ إِبْرَاهِيمَ مِنَ النَّارِ يَوْمَ عَاشُورَاءَ .
এতে কোন সন্দেহ নেই যে,এ দোয়াটি মদীনার কোন নাসেবি (আহলে বাইতের শত্রু) বা “মোসকেত” নামক স্থানের কোন খারেজি তা বর্ণনা করেছে অথবা তাদের কোন মতাদর্শী এ দোয়াটি বর্ণনা করেছে। আর এভাবেই উমাইয়ার অত্যাচারকে তারা শেষ পর্যায় পর্যন্ত পৌছায়। এটাই ছিল “শিফাউস সুদুর” নামক গ্রন্থের সারসংক্ষেপ যা এখানেই শেষ হয়ে যায়।
যাইহোক আমাদের উচিত কারবালাতে ইমাম হুসাইন (আ.) এবং তাঁর বাচ্চা ও নারীদের উপরে এজিদ বাহিনীর কৃত অত্যাচারের কথা স্মরণ করা যে, তাদের অবস্থা তখন কেমন ছিল? তাঁরা এজিদ বাহিনীর হাতে বন্দি হয়ে ক্রন্দন করছিলেন। আহলে বাইত (আ.)-এর উপরে এমনভাবে অত্যাচার করা হয় যা কোন মানুষের উপরে করা হয়নি।
আর এই কারণে ইমাম রেযা (আ.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, কেউ যদি আশুরার দিন পার্থিব চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে নিজেকে বিরত রাখে আল্লাহ তার ইহকাল ও পরকালের চাহিদাকে পূর্ণ করবেন। আর কেউ যদি এ দিনে দুঃখভারাক্রান্ত অবস্থায় থাকে এবং ক্রন্দন করে তাহলে আল্লাহ কেয়ামতের দিন তাকে প্রফুল্ল ও আনন্দিত অবস্থায় রাখবেন এবং তার চোখ বেহেশতে আহলে বাইত (আ.)-এর অবস্থান অবলোকন করার পর নূরানী হয়ে উঠবে। অপরদিকে কেউ যদি আশুরার দিনকে বরকতময় মনে করে এবং ঘরে কিছু জমা বা গুদামজাত করে তাহলে আল্লাহ এই জমাকৃত জিনিষকে তার জন্য অমঙ্গলজনক করে দিবেন এবং তাকে কেয়ামতের দিন এজিদ, ওবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ, উমর ইবনে সাআদ (লা.)এর সাথে পুণরুত্থান করবেন। এজন্য আশুরার দিন পার্থিব কাজে নিজেকে মগ্ন না রাখা উত্তম। বরং ক্রন্দন, আহাজারি এবং মাতম করা, পরিবার পরিজনকে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শোকে শোকাহত হওয়ার নির্দেশ দেয়া, খাদ্য জমা না করা এবং আসরের সময় পর্যন্ত না খেয়ে থাকা।
এই দিনে ১০০০ বার আহলে বাইতের (আ.) শত্রুদের প্রতি অভিসম্পাত করা উত্তম:
اَللَّهُمَّ الْعَنْ قَتَلَةَ الْحُسَينِ عَلَيهِ السَّلاَم.