প্রশ্নঃ সাফাভিদের আমলে কি শোক অনুষ্ঠান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল?
উত্তর: ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের পর থেকে শোক পালন করা হতো। কিন্তু আলে বুয়ের সময় পর্যন্ত (৩৫২ হি.শা.) এই শোক গোপন ছিল। চতুর্থ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত প্রকাশ্যে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোক প্রকাশ করা হতো না এবং এটা গোপনে বাড়িতে করা হতো; কিন্তু চতুর্থ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে আশুরার দিনে শোক রাস্তায় ও বাজারে করা শুরু হয়।
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোকের ইতিহাস
শাহাদাতের পর থেকেই ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জন্য শোকের মাতম চলছে। কিন্তু আল-বুয়েহের সময় পর্যন্ত (৩৫২ হি.)এটি ছিল একটি গোপন শোক। চতুর্থ শতাব্দীর আগে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোক প্রকাশ করা প্রকাশ্য ছিল না। এটা বাড়িতে ব্যক্তিগত ভাবে করা হতো; কিন্তু চতুর্থ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে, আশুরার দিনে শোক প্রকাশ্য ছিল এবং রাস্তায় ও জনসম্মুখে অনুষ্ঠিত হয়। ইসলামি ঐতিহাসিকদের বিশেষ করে যে সকল ইতিহাসবিদ ইতিহাসের ঘটনাবলি কালানুক্রমিকভাবে লেখেন; যেমন ইবনুল জাওযি কিতাবুল মুনতাযিম এবং ইবনে আছির তার কিতাবুল কামিল, ইবনে কাছির তার কিতাবুল বাদাইয় ওয়ান নাহায়ে এবং ইয়াফির মারআতুল জিনান এবং যাহাবী এবং অন্যান্য লেখকবৃন্দ 352 সালের ঘটনা এবং তার পরের বছরগুলি উল্লেখ করার সময় আশুরার দিনে শিয়া শোকের গুণাগুণ লিখেছেন।
মুয়িজ আদদৌলাহ কর্তৃক শোকের সূচনা
অন্যদের মধ্যে ইবনে জাওযি বলেছেন: ৩৫২ সালে মুয়িজ উদ্দৌলা দিলমি আশুরার দিনে লোকদের একত্রিত হওয়ার ও শোক প্রকাশ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এদিন বাজারবন্ধ করে দেওয়া হয়, বেচা-কেনা বন্ধ হয়ে যায়, কসাইরা ভেড়া জবাই করতো না, বাবুর্চিরা হরিশ (হালিম) রান্না করতো না, মানুষ পানি পান করতো না, তারা বাজারে তাঁবু ফেলে একটি শোক অনুষ্ঠান স্থাপন করে। মহিলারা তাদের মাথা ও মুখ আঘাত করেন এবং হুসাইন (আ.) এর জন্য শোক প্রকাশ করে।
হামেদানির মতে: এই দিনে মহিলারা তাদের চুল বিক্ষিপ্ত করে। যখন (শোক পালনের রীতি অনুসারে) তারা তাদের মুখ কালো করে, রাস্তায় মিছিল করে এবং ইমাম হোসাইন (আ.)এর শোকে থাপ্পড় দেয় তখন তারা তাদের মুখে আঘাত করে।
শাফেঈ বলেন: কারবালার শহিদদের জন্য সর্বজনীন শোকের প্রথা সর্বপ্রথম প্রচেলন হয় এ দিনে।
ইবনে কাছির ৩৫২ সালের ঘটনার সময় বলেছিলেন: সুন্নিদের ক্ষমতা ছিল না শিয়াদেরকে এসব কাজ থেকে নিষেধ করার। কারণ শিয়াদের সংখ্যা ছিল বেশি এবং সরকারের ক্ষমতাও তাদের কাছে ছিল।
আলে বুয়ের শাসনের পরে শোক
৩৫২ থেকে ৫ম শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত যখন আল-বুয়েহ শাসনের অবসান হয়। সেই শাসনামলে বেশিরভাগ বছরগুলিতে আশুরা অনুষ্ঠানটি সুশৃঙ্খলভাবে অনুষ্ঠিত হত। আশুরা নওরোজ বা মেহরগানের দিনের সাথে মিলে গেলে তারা ঈদের অনুষ্ঠান বিলম্বিত করতো।
মিশরে ফাতেমিয়দের শোক
একই বছর যখন ফাতেমিরা মিশর জয় করে এবং কায়রো শহর প্রতিষ্ঠা করে, তখন অনুষ্ঠানটি মিশরে পালিত হয়। মুকরিজির লেখা অনুসারে: ৩৬৩ সালের আশুরার দিনে শিয়াদের একটি দল একমত হয়েছিল (এই বাক্য থেকে এটা স্পষ্ট যে উল্লিখিত অনুষ্ঠানটি আগের বছরগুলিতেও স্বাভাবিক ছিল) তারা মাশহাদে কুলছুম এবং নাফিসা (ইমাম হাসান (আঃ)-এর সন্তানদের মধ্যে একজন)যাবেন এবং এই দুটি স্থানে তারা শোক প্রকাশ করতে শুরু করবেন। এসময় তারা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য কাঁদেন। ফাতেমীয় যুগে প্রতি বছর আশুরার অনুষ্ঠান হতো: বাজার তারা বন্ধ করতো, এবং লোকেরা কারবালার ট্র্যাজেডি সম্পর্কে শ্লোক পাঠ করতো এবং বিলাপ করতে করতে তারা কায়রোর গ্র্যান্ড মসজিদে একত্রিত হতো।
সাফাভিদের শাসনামলে শোক
এরপর শিয়া মতবাদের বিচ্ছিন্নতার কারণে শোক অনুষ্ঠানটি খুব বেশি প্রকাশ্য ছিল না। যদিও পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভাল ছিল। এর আগে আলে বুয়ের সময় কিছু সূত্র থেকে যা পাওয়া যায়, বিশেষ করে কাশেফির রওযাতুশ শুহাদা বইয়ের বর্ণনায় সাফাভিদ আমলের আগে আবি আবদুল্লাহ (সা.) এর জন্যও শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সাফাভিদের যুগের পর, শিয়া মতবাদের প্রচারের কারণে, শোক আরও সাধারণ ও সর্বজনীন রূপ ধারণ করে।
তথ্যসূত্র:
১. আল-মুন্তাজেম ফি তারিখিল মুলুক ওয়াল উমাম, ইবনুল জাওযী, খন্ড ৭, পৃ. ১৫।
২. তাকমিলা তারিখুত তাবারির, মুহাম্মদ বিন আবদুল মুলক মাকদিসি, পৃ. ১৮৩।
৩. মিরআতুল জিনান এবং ইবরাতুল ইয়কজান, ইয়াফি, খণ্ড ৩, পৃ. ২৪৭।
৪. আন নুজুমুয যাহেরা ফি মুলুকি মিসর ওয় কাহেরা, ইবনে তাগরি বেরদি, খণ্ড ৪, পৃ. ২১৮।
৫. আল খুতাত, মুকরিযি ২/২৮৯; আননুজুম আজ জাহিরা, খণ্ড ৪; পৃ. ১২৬, ইতাজ আল-হানাফা, মোগরিজি, খণ্ড ২, পৃ. ৬৭।
৬. মাকালাতে তারিখি, রাসুল জাফরিয়ান, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৮৩-১৮৫, ২০১-২০৬।