আলী নওয়াজ খান
পবিত্র কোরআনের সুরা আনআম এর ৭৪ নম্বর আয়াতটি পাঠ করার সময় উপরোল্লেখিত প্রশ্নকে সামনে রেখে কেউ কেউ আয়াতে উল্লেখিত আযর নামক লোকটিকে হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর জন্মদাতা পিতা ভেবেই তাঁকে মুশরিক মনে করেছেন। [নাউজুবিল্লাহ]।
মহান প্রতিপালক বলেন : وَ إِذْ قالَ إِبْراهیمُ لاَِبیهِ آزَرَ أَ تَتَّخِذُ أَصْناماً آلِهَةً [স্মরণ কর, যখন ইব্রাহীম পিতা আজরকে বললেন: তুমি কি প্রতিমা সমূহের উপসনা কর ?]
আয়াতটি পাঠের সাথে সাথে যে বিষয়টি সর্বপ্রথম দৃষ্টি আর্কষন করে তা হল: নিঃসন্দেহে আযর মূর্তি উপাসক ছিলেন কিন্তু আযর কি হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর জন্মদাতা পিতা ছিলেন ?
তাহলে একজন র্মূতি উপাসক পিতা কিভাবে একজন র্মূতি উপাসনা উচ্ছেদকারী সন্তান জন্ম দিলেন ?
বিষয়টির সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা জানার জন্য নিচের বিষয়গুলো মনোযোগ সহকারে দেখুন:
আরবী ভাষাতে সাধারণত «أب» শব্দ দ্বারা পিতাকে বোঝানো হয়ে থাকে। আবার কখনো কখনো «أب» শব্দ নানা ও চাচার ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে, এবিষয় নিয়ে আমরা সামনে আলোচনা করবো।
আবার কখনো কখনো «أب»শব্দ শিক্ষক ও লালন-পালনের ক্ষেত্রে যারা ভুমিকা রেখে থাকেন তাদের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়।
তবে কোন সন্দেহ নেই যে কোন পেক্ষাপট ছাড়াই «أب» শব্দটি ব্যবহার করলে সর্বপ্রথম পিতা অর্থের প্রতি সবার দৃষ্টি যাবে।
অতএব প্রশ্নটি সামনেই চলে আসে যে উপরুক্ত আয়াত অনুযায়ী ঐ র্মূতি উপাসক [আযর] লোকটি হযরত ইব্রাহীম (আ.)এর পিতা ছিলেন ?
আরো একটি প্রশ্ন হল একজন উলুল আজম (শ্রেষ্ঠ) নবীর পিতা কি একজন র্মূতি উপাসক হওয়া সম্ভব ? জন্মগত ভাবে কি একজন পিতার চিন্তাভাবনা তার সন্তানের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না ?
যাহোক এক্ষেত্রে আহলে সুন্নাতের এককাংশ মুফাচ্ছিরগণ আযরকেই হযরত ইব্রাহীম (আ.)এর জন্মদাতা পিতা হিসেবেই গ্রহণ করেছেন ।
অন্যদিকে শীয়া মাযহাবের সকল মুফাচ্ছির ও গবষেকগণ বিশ্বাস করেন যে আযর নামের মানুষটি হযরত ইব্রাহীম (আ.)এর পিতা নন বরং কেউ কেউ তাঁর নানা আবার কেউ তাঁর চাচা হিসেবে ধরেছেন। এজাতিয় তফসিরের ক্ষেত্রে শীয়া মুফাচ্ছির ও গবষেকগণ উক্ত আয়াতে «أب» শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে পেক্ষাপটটি লক্ষ্য করেছেন তা নিম্নরূপ:
(১) ঐতিহাসিক কোন গ্রন্থে হযরত ইব্রাহীম (আ.)এর পিতা হিসাবে আযর-এর নাম উল্লেখ হয়নি। বরং প্রাচীনতম গ্রন্থ বাইবেল ও ইঞ্জিল-এ হযরত ইব্রাহীম (আঃ)এর জন্মদাতা পিতার নাম তারুখ এসেছে ।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হল যারা আযরকে ইব্রাহীম (আ.)-এর পিতা হিসেবে ধরেছেন তারা এক্ষেত্রে অপব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়েছেন যা কখনো গ্রহণযোগ্য নয়। আর সেটা হল: ‘হ্যা’ ইব্রাহীম (আ.)এর পিতার নাম তারুখ ছিল বটে তবে তার উপাধী ছির ‘আযর’ ! যা ঐতিহাসিক কোন গ্রন্থে উল্লেখ হয়নি।
(২) পবিত্র কোরআনে স্পষ্টভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে কোন মুসলমানের এই অধিকার নেই সে কোন মুশরিক ব্যক্তির জন্য প্রভুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন যদিও সে তার নিকটতম আত্মীয় হয় ![সুরা তওবা ১১৩ নম্বর আয়াত]
তাহলে কিভাবে সম্ভব হযরত ইব্রাহীম (আ.) তাঁর শেষ বয়সে নিজের পিতামাতার জন্য আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রাপ্ত হওয়ার দোয়া করছেন । [সুরা ইব্রাহীম ৩৯-৪১ নম্বর আয়াত] আর সবচেয়ে লক্ষনীয় বিষয় হল এই আয়াতে পিতা অর্থ বোঝাতে আল্লাহ আবরী «أب» শব্দ ব্যবহার করেন নি বরং لِوالِدَیَّ শব্দ ব্যবহার করেছেন । যে শব্দটি আরবীভাষাতে শুধুমাত্র জন্মদাতা পিতা-মাতার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
অতএব এখানে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে মূর্তি উপাসক আযর নামের লোকটি হযরত ইব্রাহীম (আ.)এর পিতা ছিলেন না।
প্রমাণ
(৩) পবিত্র কোরআনে «أب» শব্দটি চাচার ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে যেমন সুরা বাকারা ১৩৩ নম্বর আয়াত ।
»: «قالُوا نَعْبُدُ إِلهَکَ وَ إِلهَ آبائِکَ إِبْراهیمَ وَ إِسْماعیلَ وَ إِسْحاقَ إِلهاً واحِداً»
হযরত ইয়কুব (আ.)এর সন্তানগন তাঁকে বললো : আমরা আপনার এবং পিতৃপুরুষদের ইব্রাহীম ইসমাইল ও ইসহাকের উপাস্যের ইবাদত করবো।তিনি একক উপাস্য।
আমরা সবাই জানি ইসমাইল (আ.) ছিলেন হযরত ইয়াকুব (আ.)এর চাচা; না পিতা ! অথচ এ আয়াতটিতে আব শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
(৪) মহানবী (স.) থেকে একটি অতি প্রশদ্ধি হাদিস শীয়া-সুন্নী উভয় মাযহাবের প্রশিদ্ধ হাদীস গ্রন্থগুলোতে এসেছে। মহানবী (স.) বলেন :
]لَمْ یَزَلْ یَنْقُلُنِیَ اللّهُ مِنْ أَصْلابِ الطّاهِرِینَ إِلى أَرْحامِ الْمُطَهَّراتِ حَتَّى أَخْرَجَنِی فِی عالَمِکُمْ هذا لَمْ یُدَنِّسْنِی بِدَنَسِ الْجاهِلِیَّةِ[
মহান প্রতিপালক সৃষ্টির শুরু থেকেই আমাকে পবিত্র পিতামহের মাধ্যমে পবিত্র মাতৃগর্ভে স্থানান্তর করে এনেছেন । তিনি কোন মুহুর্তেই আমার ধারাকে জাহেলিয়াতের দোষণে দূষিত করেননি। [ মরহুম তাবারসি, মাজমাউল বাইয়ান তফসির গ্রন্থে, জনাব নিশাপুরী গারাইবুল কুরআন তাফসির গ্রন্থে, জনাব ফাখরুদ্দীন রাজী তিনি তাফসির কাবীর গ্রন্থে, জনাব আলুসি তিনি তার রুহুল মাআনী নামক তাফসির গ্রন্থে, হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। বিহারুল আনোয়ার গ্রন্থের ১৫তম খন্ডে ১২পৃ, ১১৭পৃ,এবং ৩৪তম খন্ডে ৩১পৃ. এবং আওয়ায়েলুল মাকালাত গ্রন্থে ৪৬ পৃ.]
আহলে সুন্নাতের একজন বিখ্যাত গবষেক জনাব তাবারী নিজের তাফসির গ্রন্থ জামেউল বাইয়ান গ্রন্থে স্পষ্ট করেই বলেছেন যে আযার হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর পিতা নয়।[ জামেউল বাইয়ান, ৭খন্ড, ১৫৮পৃ, ৩১৬পৃ. দারুল ফিকর বৈরুত প্রকাশনী, প্রকাশ কাল, ১৪১৫ হি.।
উক্ত আয়াতে আলোচনায় তাফসির দুররে মানসুর-এ ৩খন্ড, ২৩ পৃ. প্রকাশক দারুল মাআরেফাহ, পথম প্রকাশ ১৩৬৫ হি:]
আহলে সুন্নাত মাযহাবে আরেকজন মুফাচ্ছির জনাব অলুসি নিজের রুহুল মাআনী তাফসির গ্রন্থে উক্ত আয়াতের আলোচনায় বলেন: যারা ধারণা করেন যে আযার হযরত ইব্রাহীম (আ.)এর পিতা ছিলেন না এ ধারণাটি শিয়াদের বিশ্বাস তারা ইসলামী তথ্যগত সমস্যায় ভুগছেন।কেননা আহলে সুন্নাতের অসংখ্যা গবেষক ও ইতিহাসবিদগনের বিশ্বাস হল আযার হযরত ইব্রাহীম (আ.)এর পিতা ছিলেন।[তাফসির রুহুল মাআনী, ৭খন্ড, ১৬৯ পৃ. ১৯৪ পৃ. উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায়]
আহলে সুন্নাতের আরেকজন প্রশিদ্ধ ব্যক্তি জনাব সুয়ূতী মাসালাকুল হানাফা নামক গ্রন্থে জনাব ফাখরুদ্দীন রাজীর আসরারুল তানজিল নামক গ্রন্থ থেকে মহানবীর (স.) প্রসঙ্গে উল্লেখিত হাদিসটি বর্ণনা করে বলেন : মহানবী (স.)এর পিতা-মাতার ধারাবাহিকতায় কখনো কোন মুশরিক ছিলেন না। তিনি আলোচনায় সাহি বোখারী ও দালাইলুল নাবুবাহ এবং বাইহাকী থেকেও অনেক উদ্ধৃতি বর্ণনা করেছেন।
অতএব উপরোক্ত বিষয়টি পবিত্র কোরআনের সাক্ষ্য ও র্নিভরযোগ্য ইসলামী রেওয়ায়েতের মাধ্যমে এখন সুস্পষ্ট হয়ে গেল আযর নামক ব্যক্তিটি হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর জন্মদাতা পিতা ছিলেন না। বরং তরুখ ছিলেন হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর জন্মদাতা পিতা।